উন্নতির অন্যতম পূর্বশর্ত জননিরাপত্তায় পুলিশই প্রধান ভরসা। সেই চেতনায় মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আগেই উন্নত ও জনবান্ধব একটি স্মার্ট পুলিশ ফোর্স গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নাগরিকের নিরাপত্তা ও জানমাল রক্ষায় পুলিশ বাহিনীকে সত্যিকার অর্থেই একটি কার্যকর বাহিনীতে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই ব্যাপক সংস্কার করা হচ্ছে পুলিশে। এক্ষেত্রে ২০০৭ সালের পুলিশ অধ্যাদেশের আলোকেই নেয়া হতে পারে বিশেষ উদ্যোগ। যদিও ওই অধ্যাদেশটি দীর্ঘদিন ধরেই অকার্যকর। তারপরও আজকের বাস্তবতা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশের দীর্ঘ দেড়শ বছরের পুরনো আইনকেই আধুনিকায়ন করার তাগিদ অনুভব করছে সরকার। নবনিযুক্ত আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনও দায়িত্ব নেয়ার পর একটি চৌকষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কাজ চলছে। এটা হওয়া দরকার। পুলিশকে আধুনিকায়নের জন্য বর্তমান সরকার যথেষ্ট আন্তরিক।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেড়শ বছরের পুরনো আইনেই চলছে পুলিশ। এ সময়ে পৃথিবী অনেকটা বদলে গেলেও পুরনো রূপেই রয়ে গেছে পুলিশ। সেই মান্ধাতা আমলের রীতিনীতিতেই চলে যাচ্ছে পুলিশের দিনকাল। সরকার নতুন রূপে দেখতে চায় পুলিশকে। যদিও হিমাগারে পড়ে আছে বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭। এই অধ্যাদেশ প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত সাবেক আইজিপি বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, এই অধ্যাদেশের আলোকে পুলিশকে সত্যিকার অর্থেই একটি জনবান্ধব ও স্মার্ট পুলিশে পরিণত করা সম্ভব। এজন্য পলিটিক্যাল উইল থাকলেই হবে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি নূরুল আনোয়ার বলেন, সরকার চাইলে যেকোন সময় এটা আইনে পরিণত করতে পারে। সব কিছু তো প্রস্তুত করাই আছে। পুলিশের সংস্কার হওয়া দরকার। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক পুলিশের সেবা পেতে হলে দেড়শ বছরের পুরনো আইনের সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। তবে যেই অধ্যাদেশ ২০০৭ সালে করা হয়েছে সেটা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশেই এ ধরনের আইনের অধীনে পুলিশ চালু করা হবে না। এখানেও হবে না। এটাকে আরও কিছুটা কাটছাঁট বা সংস্করণ, সংযোজন ও বিয়োজন করে একটি স্মার্ট পুলিশ গড়ার সুযোগ রয়েছে। সেটাই করতে হবে। তার কোন বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, পুুলিশকে যুগোপযোগী, জনবান্ধব, পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিনের। সবাই চায় পুলিশের সংস্কার। এ ছাড়া পুলিশের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং পুলিশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী আইনের প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে ওয়ান ইলেভেন সরকার ২০০৭ সালে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, পুলিশের সাবেক আইজি এস এম শাহজাহানের নেতৃত্বে একটি কমিটি পুলিশ সংস্কারের খসড়া অধ্যাদেশ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটির ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পরে বিভাগ, জেলা ও উপজেলার তৃণমূল পর্যায় থেকে জনমত সংগ্রহ করা হয়।
কিন্তু গত পনেরো বছরেও অধ্যাদেশটি আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়ে মিডিয়াতেও ব্যাপক লেখালেখি চলে। টক শো সভা সেমিনারে প্রায়ই প্রসঙ্গটি ওঠে। এত বছর চাপা পড়ে থাকা প্রসঙ্গটি প্রতি বছর পুলিশ সপ্তাহের সময় নানা মহলে আলোচনায় ওঠে। এর পরই আবারও চাপা পড়ে যায়। অথচ পুলিশ বাহিনীর বিপন্ন ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনে বিরাজমান অসুবিধা দূর করে তাদের একুশ শতকের প্রত্যাশা অনুযায়ী গড়ে তোলাই এ সংস্কারের লক্ষ্য ছিল বলে জানা গেছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব পুলিশের সংস্কারে বড় বাধা। পুলিশের কজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসন মনে করে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে পুলিশকে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাতে পুলিশের ওপর সরকার ও মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। সেই সঙ্গে পুলিশে রাজনৈতিক প্রশাসনের হস্তক্ষেপেরও সুযোগ থাকবে না। সবই থাকবে পুলিশ কমিশনের অধীনে। এ কারণেই অধ্যাদেশটির বিষয়ে সরকার উদাসীন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭ নামে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা যুগোপযোগী একটি প্রস্তাব। উন্নত রাষ্ট্রের পুলিশ কাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে করা হয়েছে। পুলিশ অধ্যাদেশে এমন কিছু বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কার্যকর হলে পুলিশের বিদ্যমান অনেক সমস্যা দূর হবে। যেমন-পুলিশ সদস্যদের ওপর রাজনৈতিক খবরদারি করার সুযোগ থাকবে না, চার স্তরে পুলিশের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকবে, জাতীয় পুলিশ কমিশন, অভিযোগ কমিশন, নীতিনির্ধারণী গ্রুপ গঠন ইত্যাদি বিধান কার্যকরের মধ্য দিয়ে পুলিশের ব্যাপক সংস্কার হবে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশ বিভাগের জন্য পৃথক পুলিশ বিভাগ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। যে বিভাগের প্রধানের পদবি হবে ‘চিফ অব পুলিশ’। চিফ অব পুলিশের অধীনে থাকবেন ইন্সপেক্টর জেনারেল, অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর জেনারেল, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল থেকে শুরু করে পুলিশের অন্য পদবির কর্মকর্তারা। পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেলদের মধ্য থেকে একজনকে সরকার চিফ অব পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দেবে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পুলিশের চাকরির পাশাপাশি খন্ডকালীন অন্য চাকরির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারী জনগুরুত্বপূর্ণ জরুরী কোন কাজে যেকোন ব্যক্তিকে বিশেষ পুলিশ নিয়োগ করার বিধান রাখা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার, জেলা পুলিশ সুপার অথবা চিফ অব পুলিশ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত যেকোন কর্মকর্তা সরকারের অনুমতি নিয়ে এ বিশেষ পুলিশ নিয়োগ করতে পারবেন। সেসব ব্যক্তি বেতন-ভাতা পাবেন।
বহুল আলোচিত এই অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন করা হোক এটা সময়ের দাবি। যে কারণে পুলিশ রিফর্ম প্রজেক্টের (পিআরপি) অধীনে ২০০৭ সালে প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়। ইউএনডিপির অর্থায়নে প্রায় তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার কমিশন একটা সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি স¤পন্ন করে। তখন অধ্যাদেশটি অনুমোদন করার আগে জনমত যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। অধ্যাদেশ অনুমোদনের পক্ষে ৭০ হাজার লোক মত দেন। মতামতসহ অধ্যাদেশটি আবার তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়। তিনি অভিমতসহ অধ্যাদেশটি পর্যালোচনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটি অধ্যাদেশের ২৩টি ধারাসহ কয়েকটি উপধারার ব্যাপারে আপত্তি জানায়। যেসব ধারা নিয়ে আপত্তি জানায় এর মধ্যে ৭ নম্বর ধারায় পুলিশের আইজি নিয়োগ প্রক্রিয়া, ৮ নম্বর ধারায় এএসপি নিয়োগ, ১০ নম্বর ধারার ১ উপধারায় সরকার কর্তৃক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা না থাকা, ১১ নম্বর ধারায় পুলিশ প্রশাসনের ক্ষমতা, ১২ নম্বর ধারায় ইউনিটপ্রধানের ক্ষমতা, ১৩ নম্বর ধারায় পুলিশের আইন উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, ১৫ নম্বর ধারায় জেলা পুলিশ সুপারের ক্ষমতা, ৩৭ নম্বর ধারায় জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন, ৬৮ নম্বর ধারায় পুলিশ সদস্যদের পদোন্নতি, ৯৮ ধারায় পুলিশপ্রধানের ক্ষমতার বিধান রাখা হয়। সেগুলো সংশোধন করে ২০১৩ সালে ফের একটি প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ করা হয়-যা এখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
জানা গেছে, নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এটি আলোর মুখ দেখছে না। ফাইলবন্দী হয়ে আছে পনেরো বছর ধরে। কারণ এ অধ্যাদেশে পুলিশের ক্ষমতায়নে এমন কিছু ধারা লিপিবদ্ধ করা হয়, যার বিরোধিতা করে সরকারের একটি অংশ। পরে ঝুলে যায় অধ্যাদেশটি। তার পরও প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের আলোকে পুলিশের কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ করা হয়। এর মধ্যে পুলিশ প্রধানকে দেয়া হয় সিনিয়র সচিবের মর্যাদা। পুলিশ মহাপরিদর্শকের পাঁচটি পদ সৃষ্টির ঘোষণা দেয়া হয়। এর পরও ১৮৬১ সালের পুরনো আইন সংস্কার করে নতুন আইন প্রণয়নে সরকার এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়ে। বিভিন্ন ফোরামে পুলিশের পক্ষ থেকে আইনটির যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। সরকারের উচ্চমহলকে বোঝাতে সক্ষম হয় পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা ও গতিশীলতার জন্য আইন সংস্কার প্রয়োজন।
এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এখনও কোন টক শোতে গেলেও একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তখন আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, পুলিশে কী ধরনের পরিবর্তন চান। অনেকেই বলতে পারে না। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? পুলিশে পরিবর্তন মানে কি? মানুষের পরিবর্তন না কি আইনের? আমারও কথা হলো, আমরা কেমন পুলিশ চাই? আমার বক্তব্য হচ্ছে, এমন একটি জনবান্ধব পুলিশ যা স্বাধীনভাবে মানুষের কাজ করবে। কোন দলের বা মহলের হয়ে নয়-শুধু জনগণের নিরাপত্তায় কাজ করা। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে-নারায়ণগঞ্জে যা ঘটেছে তা কী পুলিশ এড়িয়ে যেতে পারত না। যদি পুলিশ প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের মতে একটি স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে থাকত তাহলে এ ধরনের ঘটনা পুলিশ অন্যভাবে হ্যান্ডল করত কিংবা হতাহতের ঘটনা এড়িয়ে যেত।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত পুৃলিশ অধ্যাদেশ কখনোই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কেননা তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশেই এ ধরনের পুলিশ নেই। পুলিশের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না এমন পুলিশ তো যুক্তরাজ্য ফ্রান্স ও ইউরোপে দেখি। এশিয়ার কোন দেশে তো দেখি না। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে পুলিশকে রাখা হয়েছে একটি স্বাধীন কমিশনের অধীনে যার ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। সরকার শুধু অর্থায়ন করবে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জানিয়েছেন, এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যাতে পুলিশ অধ্যাদেশ-২০১৩ (খসড়া) যাচাই-বাছাই করা যায়। কিন্তু ওই রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘদিন ধরে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিমাগারে বন্দী হয়ে আছে। তবে রাজনৈতিক শক্তি যদি আন্তরিকতার সঙ্গে চায়-তাহলে এটা আলোর মুখ দেখতে পারে। এতে পুলিশের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। সাধারণ মানুষও এ বাহিনীর কাছ থেকে প্রকৃত সেবাটা পাবে। সেজন্যই এ ধরনের যুগোপযোগী একটি পুলিশ ফোর্স গড়ে তোলার প্রতি সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ রয়েছে।