সমালোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি আবারও চালু হওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেলের স্ত্রী শামীমা নাসরিনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নতুন বোর্ডও গঠন করা হয়েছে। বোর্ডে নাসরিনের মা-ভগ্নিপতি ছাড়াও রয়েছেন ই-ক্যাবের সহ-সভাপতি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব। জানা গেছে, নতুন গঠিত এই বোর্ডের প্রথম সভা হতে পারে আজ রোববার। বৈঠকে ইভ্যালির আগামীর কর্মপন্থার রূপরেখা তৈরি করা হবে। তবে নতুন করে যাত্রা শুরু করলেও প্রতিষ্ঠানটির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে।
অন্যদিকে নতুনভাবে চালু হওয়ার খবরে দীর্ঘদিন পর ধানমন্ডিস্থ ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির পুরনো কর্মীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া পণ্য কিনতে যারা অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছেন এবং যেসব মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিকে পণ্য দিয়ে টাকা পাননি সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও আসছেন।
শনিবার ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটিতে সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশ পাহারা রয়েছে। ভবনটির নিচ তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ইভ্যালির অফিসের জন্য ভাড়া নেওয়া থাকলেও এখন রয়েছে শুধু তৃতীয় ও চতুর্থ তলা। নিচের দুই তলা বাড়ি মালিককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল দেখা যায়, তৃতীয় তলার অফিস কক্ষগুলো ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। হাইকোর্ট যে বোর্ড গঠন করে দিয়েছিলেন সে বোর্ডের সদস্যরা যেসব কাগজপত্র অডিট করিয়েছেন-সেসব কাগজপত্র এই তৃতীয় তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ছিল। সেগুলো এখন গুছিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে অফিস কক্ষটি প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভবনটির চতুর্থ তলায় গতকালও হাইকোর্ট গঠিত আগের বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকা কয়েকজন আগের কর্মী কাজ করছেন।
তেমনই একজন মেহেদী হাসান সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমরা আগের বোর্ডের নিয়োগ পাওয়া কর্মী হিসেবে এখনো কাজ করছি, হয়তো চলতি মাসের বাকি কয়দিন কাজ করব। তারপর নতুন বোর্ড দায়িত্ব নিলে এবং তারা কাজ শুরু করলে হয়তো আমরা চলে যাব।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির পাঠানো সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মোট চলতি দায় ৫৪৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে মার্চেন্ট বা পণ্য সরবরাহকারীরা পাবেন ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর গ্রাহকদের পাওনা ৩১১ কোটি টাকা। এই বিশাল দায়-দেনা মাথায় নিয়েই আবার পথচলা শুরু করতে হবে ইভ্যালিকে। তবে এই পথচলার পথে যাতে আবারও কোনো ভুল না করে বা অবৈধভাবে ব্যবসা না করে কিংবা ক্রেতা না ঠকায় সে বিষয়গুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইআইটি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম আহাদ আলী খান শনিবার সময়ের আলোকে বলেন, ‘নতুন করে ইভ্যালি কীভাবে চলবে, কীভাবে তারা ব্যবসা পরিচালনা করবে- সে লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। সে গাইডলাইন মেনে ব্যবসা করতে হবে ইভ্যালিকে। সুতরাং ইভ্যালি নতুন করে শুরু করার পর তার সব কার্যক্রম পুরোপুরি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবকেও ইভ্যালির নতুন বোর্ডে রাখা হয়েছে। তবে প্রথমে উপসচিব ড. কাজী কামরুন নাহারকে রাখা হলেও তাকে বাদ দিয়ে আরেক উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলীকে বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কারণ ই-কমার্স বিষয়টি তিনিও দেখেন।’
অন্যদিকে ইভ্যালির ভবিষ্যৎ নিয়ে হাইকোর্ট গঠিত বোর্ড থেকে সদ্য দায়িত্ব ছাড়া বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক বলেন, ‘ইভ্যালি রক্ষা করা যাবে যদি কেউ বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের হাইকোর্ট দেউলিয়া ঘোষণা করার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু আমরা সেই দিকে যাইনি। কারণ হচ্ছে, কেউ যদি টাকা- পয়সা নিয়ে আগ্রহ করে আসে, তাহলে সেটার সুযোগ রেখেছি। তবে এতদিন যেভাবে চালানো হয়েছে সেভাবে চালালে এই কোম্পানি চলবে না। কারণ এই কোম্পানি চালানো হয়েছিল স্বেচ্ছাচারী পন্থায়। নিজেদের প্রফিটের জন্য। কোম্পানির মূলধন ছিল মাত্র এক কোটি টাকা। কিন্তু দেখা গেল হাজার হাজার কোটি টাকা তারা কোম্পানি থেকে খরচ করেছে, বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছে। এর সবই কাস্টমারদের টাকা। অন্যথায় এসব পণ্যে হাত দেওয়ার ক্ষমতা তাদের কখনো হতো না।’
আদালতের নির্দেশে গঠিত পর্ষদে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন গত বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আসেন।
আদালতের অনুমোদনক্রমে শামীমা নাসরিন এখন ইভ্যালির নেতৃত্বে থাকছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তার মা ফরিদা তালুকদার লিলি, ভগ্নিপতি মামুনুর রশিদ। স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে ই-ক্যাবের সহ-সভাপতি শাহাব উদ্দিন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইআইটি অনুবিভাগের উপসচিব কাজী কামরুন নাহার রয়েছেন।
অন্যদিকে ই-কমার্স সাইট ইভ্যালির পরিচালনার দায়িত্ব সাবেক চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বুঝে নেওয়ার খবরে ধানমন্ডিতে কোম্পানির কার্যালয়ের সামনে ‘ইভ্যালি মার্চেন্ট অ্যান্ড কনজ্যুমার কো-অর্ডিনেশন’ কমিটির ব্যানারে গ্রাহকরা অবস্থান করছেন। দায়িত্ব হস্তান্তরের খবর শুনে গণমাধ্যমকর্মী ও ইভ্যালির পাওনাদাররা সেখানে আসছেন প্রতিদিনই।
‘ইভ্যালি মার্চেন্ট অ্যান্ড কনজ্যুমার কো-অর্ডিনেশন’ কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক সাবিক হাসান বলেন, ‘ইভ্যালিকে তাদের পুরোনো মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। সে কারণে আমরা খুশি। পাশাপাশি তারা সমস্যার সমাধানে রাসেলেরও মুক্তি চান।’
আরেকজন ক্রেতা দাবি করেন, তিনি ইভ্যালির কাছে ১৭ লাখ টাকা পাবেন। তবে কেবল রাসেলের মুক্তির মাধ্যমেই তার সেই টাকা উদ্ধারের পথকে সুগম করতে পারে। ইভ্যালি আগের মতো ব্যবসা চালিয়ে একটু একটু করে টাকা ফেরত দিতে পারে। অথবা নতুন বিনিয়োগকারীদের কেউ বিনিয়োগ করলে সেখান থেকেও দিতে পারেন।
সদ্য বিদায়ী এমডি মাহবুব কবীর মিলন সাংবাদিকদের জানান, ‘গত ১১ মাসের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তারা হাইকোর্টের নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন। এখন আদালতের নির্দেশে নতুন কমিটি দায়িত্ব নিয়েছে। তবে তাদের বেশ কিছু শর্ত ও নির্দেশনা অনুসরণ করে চলতে হবে। এই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া করা হবে কি না- আদালত আমাদের কাছে সেই মতামত চেয়েছিল। পরিস্থিতি অনেক জটিল হলেও আমরা দেউলিয়াত্বের দিকে যাইনি। বরং এর প্রতিষ্ঠাতাদের আগ্রহকে বিবেচনায় নিয়ে তাদের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি যে, ব্যবসাটা চলবে। চলার মতো অবস্থানে রয়েছে বলেই নতুন বোর্ড দায়িত্ব নিয়েছে। তার মানে ব্যবসা চলার প্রক্রিয়ায় আছে। আদালতের প্রতিবেদনেও কিছু শর্তসাপেক্ষে ব্যবসাটা চলতে পারে বলে আমরা জানিয়েছি। ইভ্যালির নতুন চিত্র দেখতে পাবেন, এটা ইনশাআল্লাহ আমরা বলতে পারি।’
ইভ্যালির ব্যবসাটা সচল করতে হলে কত টাকা প্রয়োজন- এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহবুব কবীর বলেন, ‘এটা তো আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কারণ তাদের বার্ডেনগুলো আমরা তুলে আনতে পারিনি। যেহেতু আমরা সার্ভারে অ্যাকসেস পাইনি। তাদের দায়-দেনা কত আছে, সেটা যেহেতু আমরা তুলে আনতে পারিনি, সেই হিসাবে কত টাকা লাগবে সেটা বলা সম্ভব নয়।’
ইভ্যালিতে মোট ২৫ কোটি টাকার মতো মালামাল পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। এর আগে ইভ্যালির বেশ কিছু গাড়ি বিক্রি ও ভল্টের কয়েক হাজার টাকা উদ্ধার করতে পেরেছিল আদালত গঠিত পর্ষদ। তবে সেই টাকার অধিকাংশই গত ১১ মাসের পরিচালন ব্যয় ও অডিট রিপোর্টে তৈরির কাজে খরচ হয়ে গেছে।
তবে ইভ্যালির কর্মকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘ ১১ মাসের প্রচেষ্টায় তৈরি করা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সদ্য বিদায় নেতা পর্ষদের চেয়ারম্যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক নিশ্চিত করেন, ইভ্যালি চার হাজার ৮৬৭ কোটি ৭৫ লাখ ৪১৫ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে তুলেছিল। সে টাকার কোনো হদিস মেলেনি।
২০১৮ সালের শেষ দিকে এক কোটি টাকা নিয়ে অনলাইনে পণ্য বিক্রির ব্যবসায় নেমেছিলেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল। তিনি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন আর স্ত্রী শামীমাকে করেন চেয়ারম্যান। ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে বেশ ঘনঘন ফেসবুক লাইভে এসে অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রির নানা লোভনীয় অফার দিতেন রাসেল। বাজার মূল্যের চেয়ে কেন অর্ধেক দামে তিনি গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছে দিতে পারবেন, তার কিছু কৌশলও ব্যাখ্যা করতেন তিনি। পরে ক্রেতা ঠকানোসহ নানা অপরাধে রাসেল ও তার স্ত্রী গ্রেফতার হন ২০২১ সালে।
Like this:
Like Loading...