হঠাৎ করে উত্তর কোরিয়ার এই ধরনের কর্মকাণ্ড কেন চালাচ্ছে? কী চাইছে পিয়ংইয়ং? বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন আসন্ন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন আশা করছেন, তিনি তার দেশের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করলে সেটা মার্কিন রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে আসবে। উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে আলোচনায় থাকতে আগ্রহী বলেই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ইচ্ছা করে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে পূর্ব এশীয় অঞ্চলে। উত্তর কোরিয়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে—যাতে প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে উৎকণ্ঠার তৈরি করেছে। গত মাসে জাপানের ওপর দিয়ে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল উত্তর কোরিয়া। এরপর গত বৃহস্পতিবারও একই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল তারা। কিন্তু যে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছুড়েছিল, সেটি শেষ পর্যন্ত জাপানের আকাশসীমায় ঢুকতে ব্যর্থ হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক সূত্রের খবর অনুযায়ী, ক্ষেপণাস্ত্রটি মাঝপথে ব্যর্থ হয়ে ভেঙে পড়ে জাপান সাগরে। উত্তর কোরিয়ার এ ধরনের আগ্রাসী আচরণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এ ধরনের পদক্ষেপ বিমান এবং জাহাজ চলাচলের জন্যও একটা হুমকি।
আবার অনেক সামরিক বিশ্লেষকের মতে, উত্তর কোরিয়া আরো বড় কিছুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। যেমন হয় পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো বা প্রশান্ত মহাসাগরে পূর্ণমাত্রার দূর-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো অথবা দুটোই পরীক্ষা করা। এ ধরনের হুমকির পেছনে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। পিয়ংইয়ং ঠিক একই কাজ করেছিল ২০১০ এবং তারপর ২০১৭ সালে।
কৌশলটা ছিল প্রথমে উত্তেজনা বাড়িয়ে সেটা একটা ভীতিকর মাত্রায় নিয়ে যাওয়া। তারপর দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান আর যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে সংলাপের আহ্বান এবং কিছু ছাড় আদায়। পিয়ংইয়ং এবারেও নিঃসন্দেহে সেটাই করতে চাইছে। তবে কিমের দ্বিতীয় আরেকটি উদ্দেশ্য আছে। উত্তর কোরিয়া তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এখনো পুরোপুরি নিখুঁত করে উঠতে পারেনি। এখনো উত্তর কোরিয়া মহাকাশে পরীক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর, ক্ষেপণাস্ত্রের মাথায় বসানো অস্ত্রটি আলাদা হয়ে যাচ্ছে এবং তা লক্ষ্যবস্তুর দিকে না গিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আসছে।
আগের পরীক্ষাগুলোয় দেখা গেছে, এটি আবহাওয়ামণ্ডল দিয়ে যাওয়ার সময় যে প্রচণ্ড উষ্ণতা ও চাপ সৃষ্টি হয় সেটি ক্ষেপণাস্ত্রকে যাতে ভেঙে না ফেলে সেই প্রযুক্তিকে নিখুঁত করে তোলার কাজটা উত্তর কোরিয়া এখনো পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। কাজেই এই প্রযুক্তিকে সফল করে তুলতে তাদের আরো পরীক্ষা চালানোর প্রয়োজন রয়েছে।
উত্তর কোরিয়া শুধু দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপানকে ভয় দেখাতে চাইছে না। তাদের আসল লক্ষ্য হলো, পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হুমকি প্রদর্শন। তবে উত্তর কোরিয়ার এসব উদ্দেশ্য সফল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ উত্তর কোরিয়ার এই তত্পরতার মধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে। গত শনিবার দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর দিয়ে সুপার সনিক বোমারু বিমান উড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া বিমান বাহিনীর যৌথ মহড়ার শেষ দিনে অন্তত একটি বি-১বি বোমারু বিমান অংশ নেয়। বলা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করতেই সুপার সনিক বোমারু বিমান উড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়াও সম্প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার জবাব দিয়েছে। সীমান্তে যুদ্ধবিমানও মোতায়েন রেখেছে।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা আর তাইওয়ানের প্রতি চীনের হুমকির কারণে জাপানের রাজনীতিতে বিশাল পরিবর্তন ঘটছে। গত কয়েক দশক ধরে জাপানের দক্ষিণপন্থিরা বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটিতে যুদ্ধ ও সংঘাতবিরোধী যে সংবিধান করা হয়েছে, তা বাতিল করার এবং জাপানের অস্ত্রসম্ভার বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। এতদিন পর্যন্ত জাপানের সাধারণ মানুষ তাতে মত দেয়নি। কিন্তু এখন সেই মনোভাব বদলাচ্ছে। আগামী মাসে জাপান সরকার পরবর্তী ১০ বছরের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করার এবং দূরপাল্লার অস্ত্র সংগ্রহের প্রস্তাব দিতে চলেছে। জাপান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কয়েক শ টমাহক ক্রুজ মিসাইল কেনার ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে। সেটা যদি বাস্তবে কার্যকর হয়, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন ও উত্তর কোরিয়ার অনেক ভেতর পর্যন্ত আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করবে জাপান। যা ঐ অঞ্চলে উত্তেজনা আরো বাড়াতে পারে।