করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ আর জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বিশ্বকে মন্দায় ফেলে দিতে যাচ্ছে। বৈশ্বিক নানা সঙ্কটে জীবন ও জীবিকা এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, এ কারণে দেশে দেশে নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ উদ্বেগজনক তথ্য জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের গ্রুপের ম্যালপাস ডেভিড।
অন্যদিকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, করোনা মহামারির ধাক্কা কমে যাওয়ার পরও একটি বড় বৈশ্বিক মন্দা অবশ্যম্ভাবী বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত তিনি বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে মন্দাভাব শুরু হয়েছে। দিন দিন তার ঝুঁকি বাড়ছে। বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় দেশে দেশে কী প্রস্তুতি নেওয়া যায়, তা আলোকপাত করা হবে আগামীকাল অনুষ্ঠেয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক বোর্ডসভায়। বিদেশি পত্রিকায় গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, আমরা মূলত মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব দিতে চাই। এরপর আসবে সুদের হারের বিষয়টি। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে বেশকিছু পরামর্শ থাকতে পারে উন্নয়নশীল দেশের জন্য। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশও বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক বোর্ডসভায় অংশগ্রহণ করছে। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নাও যেতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। সে ক্ষেত্রে দলের নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ড. শরীফা খাতুন বলেন, ‘মূলত এই বার্ষিক সভায় আগামী দিনের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করা হবে। পাশাপাশি মন্দা মোকাবিলার পরিকল্পনা অবহিত করা হবে। এ ছাড়াও কোন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে বা আমরা কোন কোন প্রকল্পে অর্থায়নের সহায়তা চাই তা উল্লেখ করা হবে।’
আগামী ১০ অক্টোবর শুরু হওয়া বোর্ডসভা ১৬ অক্টোবর শেষ হবে। ২০১৯ সালের পর এই প্রথম সশরীরে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক বোর্ডসভা হতে যাচ্ছে।
অবশ্য ইতোমধ্যে জাতিসংঘ বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, বিশ্বমন্দা দ্বারপ্রান্তে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর।
আঙ্কটাড যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- মুদ্রা, রাজস্বনীতি ও সুদের হার বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে বিশ্বকে একটি বৈশ্বিক মন্দা ও স্থবিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদের ঘণ্টা বাজছে। এ বিষয়ে অবশ্য পরে তিনি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে আঙ্কটাড মহাসচিব রেবেকা গ্রিনস্প্যান বলেছেন, আমাদের এখনও মন্দার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসার সময় আছে। যদি দেশগুলো কৌশলগতভাবে মূল্যস্ফীতি প্রশমিত করে। ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তার জন্য ব্যবহার করে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার প্রবণতার বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি খাতের অর্থনীতিবিদদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে সাতজন বলেছেন, তারা মনে করেন ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিতে পারে। অবশ্য বছরের শুরুতেই গুঞ্জনের মতো বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কথা আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা ও সতর্কতা জোরালো হচ্ছে। উন্নত অর্থনীতিতে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে প্রায় ৯০টি উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রা এ বছর ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়েছে। সর্বশেষ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা মন্দার আভাস দিল।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক বাণিজ্য সংস্থাটির মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো বিবিসি ও রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আগামী বছর বাণিজ্য বৃদ্ধি নেতিবাচক দিকে রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্র্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতি বহুমুখী সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আর্থিক সঙ্কটে রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও ঋণ সঙ্কটের কারণে নিম্ন আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলো গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংকের বিশ্বখাদ্য কর্মসূচিসংক্রান্ত সংস্থাও। একই সঙ্গে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি আগামী বছর বিশ্বব্যাপী কী হতে পারে তারও একটি আভাস দেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়েও কথা বলেন।
বাংলাদেশ কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, তা নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে। যেখানে রফতানি আয় কমে যাওয়া, আমদানি করা খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
শনিবার ঢাকায় একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। সেখানে আলোচকরা বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে কর্মপরিকল্পনার কথা বলেন। একই সঙ্গে সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলা করতে বাংলাদেশ সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। তবে বিদ্যুৎ সঙ্কটের বিষয়ে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।