এফপিএমসির বৈঠক সূত্র জানায়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার দ্রুত চাল ও গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সরকার বলে আসছে, দেশে চালের সংকট নেই। আবার অভ্যন্তরীণ গম সংগ্রহ না হওয়ায় গম আমদানির পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এফপিএমসি। এতে গম আমদানির জন্য বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ আছে তার চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হবে সরকারকে। বাজেট তৈরির সময় চাল ও গম আমদানিতে ডলারের দাম ৮৭ টাকা ধরা হয়েছিল। বর্তমানে ডলারের দাম ১০৭ টাকা। আবার চাল ও গম দুটিই আমদানি করতে হচ্ছে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে। ফলে সরকারের আমদানি খরচ বাড়ছে।
ডলারের বিনিময় হার, আমদানি শুল্ক ও ভাড়া বৃদ্ধির কারণে চাল ও গম আমদানি করতে সরকারকে বাজেটে রাখা বরাদ্দের অতিরিক্ত চার হাজার ৫৭০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। এর মধ্যে চাল আমদানিতে সরকারের ব্যয় বাড়বে তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর গম আমদানিতে ৭৭০ কোটি টাকা।খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভার কার্যপত্র থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
এফপিএমসির বৈঠকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী ১০ লাখ টন চাল আমদানির সার-সংক্ষেপ অনুমোদন করেছেন। এতে শুল্ক ছাড়া অতিরিক্ত তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। আগে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগত না। কিন্তু চলতি অর্থবছরে চালের ক্ষেত্রে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ শতাংশ এবং ডিসেম্বরের পর ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এতে চাল আমদানি বাবদ সরকারকে ৭৭০ কোটি টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। তবে গমের ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক লাগবে না।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে এই কমিটির সভা হয়।দেশে চাল ও গমের উৎপাদন গত বছরের চেয়ে চলতি বছর চার লাখ টন বেশি হয়েছে। তার পরও এ বছর ৯ লাখ ৩০ হাজার টন চাল এবং সাড়ে ছয়লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে সরকারকে। এর মধ্যে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার টন চাল এবং সাড়ে ছয় লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। বাকি চার লাখ টন চাল চুক্তির প্রক্রিয়াধীন।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘বিশ্ব খাদ্য সংস্থা যেটা বলছে, তার জন্য আগাম সতর্কতা হিসেবে আমরা চাল আমদানি করছি। আমরা ১০ লাখ টন চাল আমদানি করব সরকারিভাবে। তার মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখ টনের চুক্তি করা হয়েছে। ’ বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা।
সরকার কেন চাল আমদানিতে শুল্ক বসিয়েছে, জানতে চাইলে চট্টগ্রামের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কমিশনার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণত দেশে যখন উত্পাদন বেশি থাকে তখন শুল্ক বাড়িয়ে আমদানি কমানো হয়। আবার যখন উত্পাদন কম হয় তখন শুল্ক কমিয়ে আমদানি বাড়ানো হয়।চাল আমদানি করা হয়েছে এক লাখ টন : চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে থাইল্যান্ড থেকে দুই লাখ টন, ভিয়েতনাম থেকে ৩০ হাজার টন, মিয়ানমার থেকে দুই লাখ টন এবং ভারত থেকে এক লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ভারত থেকে এক লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ইউক্রেন থেকে ৫০ হাজার টন, বুলগেরিয়া থেকে এক লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে জিটুজির মাধ্যমে পাঁচ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছে সরকার।
অভ্যন্তরীণ গম সংগ্রহ বন্ধ : চলতি অর্থবছরে দেড় লাখ টন গম অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ না হওয়ায় এখন চাহিদার পুরোটাই আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে ৭৭০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে।প্রতিবছর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে ধান-চালের দাম নির্ধারণের পাশাপাশি গমের দামও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার ধান-চালের দাম নির্ধারণ করা হলেও গমের দাম নির্ধারণ করা হয়নি।
কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে বাজারে গমের দাম নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। সরকার গম সংগ্রহ বন্ধ করার ফলে কৃষক উত্পাদনে নিরুৎসাহ হতে পারেন।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সার ও গমের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো বিকল্প বাজার থেকে আমদানি করা হবে। কৃষক কোনো সমস্যায় পড়বেন না। তিনি বলেন, ধান-চাল সংগ্রহ এবং সার বিতরণে সরকার বিপুল অঙ্কের টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ভর্তুকির পরিমাণও বাড়াতে হচ্ছে।উত্পাদন বেড়েছে, তবু আমদানি বাড়ছে : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে তিন কোটি ৮৬ লাখ ৯৩ হাজার টন চাল-গম উৎপান্ন হয়েছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপান্ন হয়েছে তিন কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার টন। এর পরও আমদানি বেড়েছে।
বর্তমানে খাদ্যশস্য মজুদ আছে ১৫ লাখ ৬৪ হাজার টন। এর মধ্যে চাল আছে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন এবং গম এক লাখ ৯৮ হাজার টন।খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, গম ও সারের দাম যে হারে বেড়েছে, তা সামনে আরো বাড়তে পারে। ফলে বাংলাদেশ সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদে বিকল্প বাজারের দিকে যেতে হবে। এ জন্য কূটনৈতিক তৎপারতা বাড়াতে হবে।
বেসরকারি আমদানিতে ভাটা : বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ১৪ লাখ ৯২ হাজার টন। এর মধ্যে এলসি খোলা হয়েছে আট লাখ ৯১ হাজার ২১০ টন চালের। তবে আমদানি করা হয়েছে মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার ৪৭০ টন।
আর গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত গম আমদানি করা হয়েছে চার লাখ ১২ হাজার টন। গত অর্থবছরের এই সময়ে ৯ লাখ ৪৭ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছিল।খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, বেসরকারিভাবে যদি রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করা না যায়, তাহলে আর্জেন্টিনা ও কানাডা থেকে তারা আনতে পারে। যদি বেসরকারি খাতে গম না আসে, তাহলে চালের ওপর চাপ বাড়বে।