২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সময় উত্তরাধিকার সূত্রে খেলাপি ঋণ পায় ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি এবং ঋণখেলাপিদের বারবার সুযোগ দেওয়ার পর সেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ব্যাংকগুলোর দেওয়া এই তথ্যেই খেলাপি ঋণে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে দেশ। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এমন ঋণের পরিমাণ বাস্তবে আরও অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে খেলাপি ঋণ কমানোর কোনো বিকল্প দেখছে না বিশ^ব্যাংক।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম চেঞ্জিং অব ফেব্রিক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। এতে বলা হয়েছে, উৎপাদনশীলতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে খেলাপি ঋণ। এর ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা; যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। যার একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে।
ওই প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে বেশকিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছে বিশ্বব্যাংক। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা। পরিচালকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া। পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
পরিচালকদের দায়িত্ব পালন ও জবাবদিহিতার জায়গা তৈরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে বলেছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া বলা হয়েছে, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং ব্যয়বহুল ব্যাংকের ব্যর্থতা এড়াতে সম্পদের গুণমান উন্নত করতে হবে। এ জন্য দেশের রাষ্ট্রায়ত্তসহ তফসিলি ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, দেশের ব্যাংকিং খাত প্রায়ই বিশেষ ব্যক্তি ও সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। এ জন্য এ খাতে জেঁকে বসেছে অনিয়ম-দুর্নীতি। সম্ভব হয় না সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে ঋণ অনুমোদন, প্রস্তাব যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে প্রভাবশালী এই গোষ্ঠী।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, নতুন করে যাতে ঋণখেলাপি তৈরি না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য ঋণ বিতরণে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি হওয়া ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া আইনি প্রক্রিয়া সচল করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আগে রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক ও বিশেষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বর্তমানে তা ব্যাপকভাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো প্রায়শই অ-আর্থিক সংস্থায় আগ্রহী ব্যক্তি বা সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ছাড়াও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকরা বর্তমানে অনেক ব্যাংকের বোর্ডে বসে আছেন। এ জন্য স্বাধীন পরিচালকের কার্যকারিতা বেশ দুর্বল। যদিও সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেনের ওপর কিছু বিধিনিষেধ কাগজে-কলমে বিদ্যমান।
সেই বিধিবিধানগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সর্বোত্তম কার্যক্রম এবং বাস্তবে নিজেদের কার্যকলাপে কয়েকটি বাধা রয়েছে। সেগুলো তারা মানেন না। যেমন- পরিচালকদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি ঠেকাতে, এক ব্যাংকের পরিচালকরা অন্য ব্যাংকের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ না হয়েও এই সুবিধা নেন তারা। ব্যাংক খাতে এই ঘটনা উদ্বেগজনক আকারে পৌঁছেছে। অথচ খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ এটিও। বিশ্বব্যাংকের অনুমান- ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট ঋণের অন্তত ২০ শতাংশ পরিচালকদের দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হলে, পরিচালকদের অন্যান্য ব্যাংক থেকে, সরাসরি বা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে নিজ বা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগের ঋণ নিয়মিতকরণ করে দেখানো হচ্ছে, যা নিয়ম ও নীতিবহির্ভূত।