বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শিল্প। হোয়াইট গোল্ড খ্যাত এই জিআই পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় কোটি লোক জড়িত। আর এই পণ্যের সিংহভাগ রপ্তানি হয় বৃহত্তর খুলনা অঞ্চল থেকে। ৬০-এর দশকে খুলনা অঞ্চলে চিংড়ির চাষ শুরু হয়। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় চিংড়ির দেহে ফিটকিরির পানি, ভাতের মাড়, সাগু, এরারুট, লোহা বা সিসার গুলি, মার্বেল, ম্যাজিক বল, জেলিসহ বিভিন্ন ধরনের পদার্থ মিশিয়ে এক ধরনের তরল পদার্থ তৈরি করে চিংড়িতে পুশ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শিল্প। বিভিন্ন সময় বাতিল হয়েছে শিপমেন্ট। এ অবস্থার পরিবর্তনে সংশ্লিষ্টরা সরকারের আরও কঠোর পদক্ষেপ চান।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি খেলে লিভার, কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অসাধু কাজ বন্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেও ফল মিলছে না। গত ২ দিনে খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে ৩ হাজার কেজি অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি জব্দ করা হয়।
গত আগস্ট মাসে রূপসার ‘প্রিয় ফিশ ডিপো’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৭ জনকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। এ সময় ৭০ কেজি অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি জব্দ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনার নতুন বাজার ও রূপসা এলাকায় ৭শ’র বেশি ডিপো রয়েছে। এখানকার কিছু ডিপোতে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অভিযোগ রয়েছে। কেজিতে ১০০-২০০ গ্রাম অপদ্রব্য পুশ করা হয়। এতে গ্রেড হিসেবে দাম বেড়ে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা অপদ্রব্য ঢুকিয়ে এসব মাছ বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রি করে। এসব মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি ফেরত দিলে তা চলে যায় দিনাজপুর, পঞ্চগড়, বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গ, ঢাকার সাভার, সদরঘাট, কাওরান বাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস হুমায়ুন কবির বলেন, চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের অন্যতম কারণ কোম্পানির অসৎ কর্মচারীরা। মালিকের চোখ আড়াল করে এরাই কোম্পানিতে চিংড়ি অপদ্রব্য ঢুকিয়ে থাকে। ফলে মালিকরা এখন আর ২৪ ঘণ্টা মাছ নেন না। এখন রাত ১০টা পর্যন্ত মাছ কেনা হয়।
তিনি আরও বলেন, অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি বিভিন্ন কোম্পানি ফেরত দিলে তা চলে যায় দিনাজপুর, পঞ্চগড়, বগুড়াসহ উত্তর বঙ্গসহ স্থানীয় বাজারে। এখন ওই অঞ্চলেও চিংড়ি পাওয়া যায়। কারণ স্থানীয় বাজারের ক্রেতারা ওইসব চিংড়ি ধরতে পারেন না। খেয়ে অসুস্থ হওয়ার পর বুঝতে পারেন চিংড়িতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই মাছ ব্যবসায়ী আরও বলেন, একটা শিপমেন্টে কমপক্ষে ২শ’ জন রপ্তানিকারকের মাছ থাকে। তাদের মধ্যে যেকোনো একজনের প্যাকেটে সমস্যা হলে পুরো শিপমেন্টই বাতিল হয়। সেক্ষেত্রে একটি শিপমেন্টেই কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। আর ওই শিপমেন্ট দ্বিতীয়বার পাঠাতে গেলে মাছের দাম কম দিতে হয়। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
র্যাব-৬ এর পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তাক আহমদ বলেন, জিআই পণ্য চিংড়িতে অপদ্রব্য মিশ্রণকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।
খুলনার মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আবু ছাইদ বলেন, চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে মৎস্য বিভাগ সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। জনবল স্বল্পতার কারণে অভিযান নিয়মিত করা দুষ্কর হচ্ছে। তারপরও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।