চিপ ব্যবসায় স্যামসাংকে ফের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে তাইওয়ানভিত্তিক টিএসএমসি। তৃতীয় প্রান্তিকে আয় কমার ফলে টিএসএমসির কাছে অবস্থান হারাতে পারে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক কোম্পানিটি। মেমোরি চিপে একক আধিপত্য থাকলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চাহিদায় শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে।
বিক্রির দিক থেকে ২০১৭ সালে শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোম্পানি হিসেবে নাম লেখায় স্যামসাং। এর আগে ২৪ বছর শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোম্পানির স্থান দখল করে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টেল। স্যামসাংয়ের উচ্চ প্রযুক্তির ডির্যাম ও ফ্ল্যাশ স্টোরেজ প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব স্মার্টফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিকস পণ্যের উচ্চ চাহিদায় ভর করে পরবর্তী কয়েক বছরে সেমিকন্ডাক্টরে শীর্ষস্থান তাদের। ২০১৯ সালে স্যামসাংকে হটিয়ে শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোম্পানি হিসেবে নাম লেখায় ইন্টেল। তবে ২০২১ সালে ফের শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করে স্যামসাং।
মূলত মেমোরি চিপে আধিপত্যের মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টরে শীর্ষস্থানের কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চাহিদায় শ্লথগতিতে হুমকিতে পড়েছে স্যামসাং। টানা দুই প্রান্তিকে স্যামসাংয়ের ডির্যাম বিক্রি কমেছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে নিট মুনাফা ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ কমার শঙ্কা করছেন তারা। তিন বছরের মধ্যে এই প্রথম আয় কমছে দক্ষিণ কোরীয় কনগ্লোমারেটটির।
শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোম্পানি হিসেবে টিএসএমসির কাছ থেকে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ অনুভব করছে স্যামসাং। ৩ ন্যানোমিটারের প্রসেসরের জন্য কোয়ালকমের মতো প্রতিষ্ঠান স্যামসাং ছেড়ে টিএসএমসির তীরে ভিড় জমিয়েছে। অ্যাপলও তাদের ৩ ন্যানোমিটারের এমথ্রি ও এ১৭ বায়োনিক চিপের চুক্তিভিত্তিক নির্মাতা হিসেবে স্যামসাংকে বাদ দিয়ে টিএসএমসিকে পছন্দ করেছে।
গত সপ্তাহে তৃতীয় প্রান্তিকের আয়ের উপাত্ত প্রকাশ করেছে টিএসএমসি। বিশ্ব অর্থনীতিতে শ্লথগতি বিরাজ করলেও জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার আয় করেছে তাইওয়ানভিত্তিক কোম্পানিটি। বিশ্লেষকদের প্রাক্কলন, চিপ সেগমেন্টে তৃতীয় প্রান্তিকে স্যামসাং বড়জোর ১ হাজার ৭৮০ কোটি ডলার আয় করতে পারে। এ প্রাক্কলন সঠিক হলে স্পষ্ট ব্যবধানে স্যামসাংকে হটিয়ে শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোম্পানি হবে টিএসএমসি।
মেমোরি চিপের চাহিদায় শ্লথগতির কারণে স্যামসাংয়ের চিপ বিক্রি বড় আকারের ধাক্কা খেয়েছে। এদিকে চুক্তিভিত্তিক চিপ নির্মাণ এবং প্রিমিয়াম চিপ সরবরাহের মাধ্যমে সর্বাধুনিক চিপের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য টিএসএমসির। তাদের গ্রাহক তালিকায় রয়েছে কোয়ালকম, অ্যাপল, এনভিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠান। মেমোরি পণ্যের দাম আরো কমার শঙ্কায় সামনের দিনগুলো স্যামসাংয়ের জন্য আরো খারাপ খবর নিয়ে আসবে।
এদিকে স্যামমোবাইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সপ্তাহে বাইডেন প্রশাসনের বিধিনিষেধ আরোপের পর সেমিকন্ডাক্টর শিল্প ২৪ হাজার কোটি ডলার বাজার মূলধন হারিয়েছে।
বৃহস্পতিবারের সিদ্ধান্তের পর টিএসএমসি ৭ শতাংশ বাজার মূলধন হারিয়েছে, ২০২১ সালের মে মাসের পর যা সর্বোচ্চ। স্যামসাং, এসকে হাইনিক্স ও টোকিও ইলেকট্রন লিমিটেডের বাজার মূলধন হারিয়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৯, ৩ দশমিক ৫ ও ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের পরিচালন মুনাফা ৩২ শতাংশেরও বেশি কমেছে। নিক্কেই এশিয়ার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় সেমিকন্ডাক্টর, স্মার্টফোন ও গৃহস্থালি পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাসে আয় কমেছে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্টটির।
চলতি মাসের শুরুতে স্যামসাং এক প্রাক্কলনে জানায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তাদের ১০ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ওন বা ৭৭০ কোটি ডলার পরিচালন মুনাফা হয়েছে, ২০২১ সালের একই প্রান্তিকের তুলনায় যা ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ কম। তবে কোম্পানির মোট আয় গত বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ৭৬ ট্রিলিয়ন ওনে দাঁড়িয়েছে। প্রাক্কলনে আরো বলা হয়, স্যামসাংয়ের পরিচালন মুনাফা প্রান্তিকওয়ারি ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মোট আয় ১ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। কোম্পানিটি বিস্তারিত তথ্য না জানালেও শিগগিরই আয়-ব্যয়ের উপাত্ত সবিস্তারে জানাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কোরিয়া হেরাল্ড বলছে, ২৭ অক্টোবর তৃতীয় প্রান্তিকে আয়-ব্যয়ের সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করবে স্যামসাং।
একদল বিশ্লেষকের আয়ের পূর্বাভাস থেকে কম আয় করেছে স্যামসাং। ২১টি ব্রোকারেজ হাউজের উপাত্ত সমন্বয় করে এফএনগাইডের পূর্বাভাস ছিল, তৃতীয় প্রান্তিকে স্যামসাংয়ের পরিচালন মুনাফা ও মোট আয় হবে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ও ৭৮ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ওন।
চই দো-ইওন নামে শিনহান সিকিউরিটিজের এক বিশ্লেষক নিক্কেই এশিয়াকে জানান, স্মার্টফোন, পিসি ও টিভির চাহিদা দ্রুত কমছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো সেমিকন্ডাক্টরের ক্রয়াদেশেও বড় আকারের পতন হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আরো কয়েক প্রান্তিকে স্যামসাংয়ের আয় কমবে। চাহিদায় শ্লথগতির কারণে মেমোরি চিপের চাহিদাও কমবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মুডি’স ইনভেস্টরস সার্ভিস জানায়, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ডির্যাম ও ন্যান্ড মেমোরি শিল্প বড় আকারের ধাক্কা খাবে। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধেও চাপের মধ্যে থাকবে এ শিল্প। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে স্মার্টফোন ও কম্পিউটার বিক্রিতে যে চাঙ্গা ভাব দেখা গিয়েছিল সেটি এখন আর নেই। গত কয়েক প্রান্তিকে যে বিক্রি কমছে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তৃতীয় প্রান্তিকের উপাত্তে।
কোরিয়া হেরাল্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চতুর্থ প্রান্তিক নিয়েও স্যামসাংয়ের তেমন আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই। শিল্পোৎপাদন খাতে শ্লথগতিতে সেমিকন্ডাক্টরের চাহিদা নিকটভবিষ্যতে চাঙ্গা হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এফএনগাইডের পূর্বাভাসে বলা হয়, পরবর্তী প্রান্তিকে স্যামসাংয়ের পরিচালন মুনাফা ১০ ট্রিলিয়ন ওনের নিচে নেমে আসতে পারে।