রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৭ পূর্বাহ্ন

বিমানবন্দরের ভেতরে মাদক পাচারের চক্র

প্রতিনিধির / ১৯০ বার
আপডেট : রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০২২
বিমানবন্দরের ভেতরে মাদক পাচারের চক্র
বিমানবন্দরের ভেতরে মাদক পাচারের চক্র

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শাহজালাল বিমান-বন্দরকে মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে—এমন তিনটি চক্রকে তাঁরা শনাক্ত করেছেন। এসব চক্রের প্রতিটিতে ৫০-৬০ জন সদস্য আছে। অধিদপ্তরের মতে, এর জন্য মূলত দায়ী লাগেজে পণ্য পরিবহনের সময় স্ক্যানিং ঠিকমতো না হওয়া।

মাদক পাচার চক্রের শিকার হয়েছেন এমন কয়েকজন এবং তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে আজকের পত্রিকা। তাঁদের একজন সৌদিপ্রবাসী শ্রমিক আবুল বাশার। ২০ বছরের সাজা নিয়ে তিনি এখন সৌদি আরবের কারাগারে। বাশারের পরিবারের সদস্যরা জানান, গত বছরের মার্চে সৌদি আরব যাওয়ার জন্য চেকিং, স্ক্যানিং শেষ করে বোর্ডিং পাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এ সময় বিমানের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি একটি খাবারের প্যাকেট তাঁর হাতে দিয়ে সেটা সৌদি আরবে থাকা তাঁর ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতে বলেন। বাশার এই প্যাকেট নিতে না চাইলে ওই ব্যক্তি বিমানে উঠতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেন। এরপর প্যাকেটটি বাশারের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেন। জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছার পর নিরাপত্তা-কর্মীরা ব্যাগের ভেতরে কয়েক হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট পেয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। সেই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি এখন জেদ্দা কারাগারে।

আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
বাশারকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ঢাকা বিমানবন্দর থানায় বিমানের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া সেই ব্যক্তির নামে প্রতারণার মামলা করেন তাঁর স্ত্রী রাবেয়া। এ মামলা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে বিমানের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি আসলে বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী নূর মোহাম্মদ। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাঁকে আটক করে পুলিশ।

বাশারের বিষয়টি আলোচনায় এলেও একইভাবে প্রতারিত হয়ে মাদক মামলায় সৌদিতে জেলে আটক থাকা ময়মনসিংহের নান্দাইলের মো. তোফায়েল হোসেন ও সাভারের তোফাজ্জল হোসেনের বিষয়টি অনেকেই জানেন না। গত জুলাইয়ে ছুটি কাটিয়ে সৌদি ফেরার সময় পাশের গ্রামের পরিচিত হৃদয় মিয়ার অনুরোধে একটি ব্যাগ নিয়ে সৌদি যান তোফায়েল। সৌদির জেদ্দা বিমানবন্দরে চেকিংয়ের সময় ওই ব্যাগ থেকে হেরোইন ও ইয়াবা উদ্ধার করে সৌদি পুলিশ। তারপর থেকে সৌদির কামিজ জেলে বন্দী তোফায়েল। এই ঘটনায় হৃদয় ও তাঁর বাবা ছোবহানের বিরুদ্ধে মামলা করেন তোফায়েলের স্ত্রী মরজিনা। এই মামলায় আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন হৃদয় ও তাঁর বাবা। প্যাকেটটি যে হৃদয় দিয়েছিলেন এটা গ্রামের সবাই জানেন এবং গ্রামীণ সালিসে হৃদয় তা স্বীকারও করেন। এরা ছাড়া বিমানবন্দরের বিভিন্ন কর্মচারী, কর্মকর্তা ও প্রতিবেশীদের ফাঁদে পড়ে গত দুই বছরে এমন আরও পাঁচজন সৌদির বিভিন্ন জেলে সাজা খাটছেন বলে জানা গেছে।

মাদক পাচারের এমন কৌশল নজর এড়িয়ে যায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক মাদক পাচারের বিভিন্ন মাধ্যম ও কৌশল সম্পর্কে এই সংস্থা জানলেও শ্রমিকদের টার্গেট করে এভাবে মাদক পাচারের বিষয়টি তাঁদের জানা নেই বলে মাদক নিয়ন্ত্রণের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অপারেশনস) মো. আহসানুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা কুরিয়ারের মাধ্যমে মাদক পাচারসহ অন্য যেসব উপায়ে মাদক পাচার করা হচ্ছে, সেগুলো নজরে রাখছি। বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অনেককেই গ্রেপ্তার করেছি। কিন্তু এভাবে শ্রমিকদের টার্গেট করে মাদক পাচারের খবর আমাদের কাছে নেই।’

সৌদি আইনে বাধা না থাকায় আজকের পত্রিকার সঙ্গে জেদ্দা জেলে বন্দী থাকা বাশার ও তোফাজ্জলের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে কথা হয়। বাশার বলেন, ‘প্রকৃত দোষীকে শাস্তির আওতায় এনে আমাকে যেন দ্রুত মুক্ত করা হয়।’ আর তোফাজ্জল দাবি করেন, তাঁর ওই ব্যাগে আরও চারজন সৌদিপ্রবাসী শ্রমিকের খাবার থাকায় নির্দোষ হয়েও তাঁরা জেল খাটছেন। তাঁরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গাঁজা ও ইয়াবাতে আসক্ত হচ্ছেন তাঁরা।

বাশার, তোফাজ্জল ও তোফায়েলের মতো ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তার জন্য অর্থ দিয়ে থাকে বাংলাদেশের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। এই বোর্ডের তথ্যমতে, চলতি বছর সৌদির বিভিন্ন জেলে ৩৪ জন বাংলাদেশি নারী-পুরুষ নানা অপরাধে সাজা খাটছে। যার মধ্যে ১৪ জনই মাদক মামলায়।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বিমানবন্দরে ডগ স্কোয়াড রাখার দাবি জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু কোনো এক কারণে এটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষকে দামি উপহার দিলেই সে ম্যানেজ হয়ে যায়। স্ক্যানারের মতো যন্ত্র চাইলে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু ডগ স্কোয়াড রাখলে তাকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা সম্ভব না।’

সাধারণ যাত্রীদের ফাঁদে ফেলে কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষের এ ধরনের অনৈতিক কাজকে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীনতা হিসেবে দেখছেন বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম। তিনি বলেন, বিমানবন্দরে অবশ্যই চক্র কাজ করে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের চক্রের সদস্য বা সুযোগসন্ধানীরা যাতে সাধারণ যাত্রীদের বিপদে ফেলতে না পারে, তা দেখার দায়িত্ব তাদের। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের গাফিলতি দায়ী।

তবে এটা মানতে রাজি নয় শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সিভিল অ্যাভিয়েশন, অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি, এপিবিএন এবং গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে আমরা কাজ করি এবং অনেকগুলো স্তর অতিক্রম করে যাত্রীরা পার হন। এরপরও কোনো কিছু যদি চলে যায়, সেটাও আমরা চেক ও স্ক্যান করে বের করে ফেলি। বিমানবন্দরে কোনো চক্র থাকার প্রশ্নই আসে না।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ