মহামারীর কারণে বিলম্বিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে ভালো প্রস্তুতি সেরেছেন মারুফা মুস্তাফিজ মুক্তি; ভালো ফলের প্রত্যাশা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় কী হবে, তো নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কথা বললেন এইচএসসির পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢোকার আগ মুহূর্তে।
সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে অনলাইনে ক্লাস আর হঠাৎ বন্যায় পরীক্ষা পেছানোয় প্রস্তুতিতে ঘটেছে ব্যাঘাত; তবুও ভালো ফলের প্রত্যাশা করলেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ও উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।ঢাকার মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের এই শিক্ষার্থীর আসন পড়েছে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজ কেন্দ্রে। রোববার এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর দিন নির্ধারিত সময়ের আগেই বাবা মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কেন্দ্রে আসেন তিনি।
জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এমনিতেই দেরি হয়েছে। পরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় পরীক্ষা আরও পিছিয়ে যাওয়ায় পড়ালেখার মনোযোগ ধরে রাখতে পারেননি সেভাবে।
“তারপরও শর্ট সিলেবাস শেষ করেছি। প্রিপারেশন ভালো, কিন্তু আমাদের ভর্তি পরীক্ষা হবে পুরো সিলেবাসে। সেটা নিয়েই এখন বেশি টেনশন কাজ করছে।”মুক্তির বাবা মুস্তাফিজুর রহমানের বিশ্বাস, বোর্ডে তার মেয়ে ভালো ফলাফল করবে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় মেয়ে কতটুকু শিখল, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।“সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বাচ্চাদের পরীক্ষা ভালোই হবে। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের পড়ালেখা শিক্ষাজীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেখানটায় ওদের ছেদ পড়েছে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের কারণে ওরা পুরো বই পড়েনি। সারাজীবন এই গ্যাপটা থেকে যাবে।”
রোববার বেলা ১১টায় দেশের নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে বাংলা প্রথম পত্র, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে কুরআন মাজিদ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে বাংলা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে।কোভিড ও বন্যার কারণে কয়েক ধাপে পিছিয়ে স্বাভাবিক সময়ের সাত মাস পর এ পরীক্ষায় বসেছে শিক্ষার্থীরা। গত বছরের মত এবারও বিষয়, নম্বর ও সময় কমিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
ঢাকার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীর চেয়ে অভিভাবকদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের সরিয়ে দিলেও আবার তারা জটলা পাকাচ্ছেন।মিরপুর ১০ নম্বরের মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছেন শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ, প্রাইম সিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, সরকারি সংগীত কলেজ, কল্যাণপুর গার্লস স্কুল ও কলেজ এবং মিরপুর সায়েন্স কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এই কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা কাফরুল থানার কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন বলছিলেন, “শান্ত-শিষ্ট পরিবেশে সবাই কেন্দ্রে প্রবেশ করছে। তবে অভিভাবকরাই বেশি ঝামেলা করছে। তারা কেন্দ্রের সামনে থেকে সরতেই চান না। তাদের বারবার সরিয়ে দিতে হচ্ছে।”
পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে প্রবেশের নির্দেশনা থাকলেও অনেক পরীক্ষার্থীকে এরপরেও কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের তল্লাশি করে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেন।শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সিনথিয়া রহমান পরীক্ষা শেষে জানালেন, তার প্রশ্ন ‘কমন’ পড়েছে, পরীক্ষাও ভালো দিয়েছেন।কিন্তু তার বাবা সিরাজুল ইসলাম টিপু মেয়ের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সন্তুষ্ট নন। মহামারীর কারণে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ‘তেমন শিখতে পারেনি’ বলে তার ধারণা।
“সায়েন্সে কী অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে হয়? সায়েন্স হাতে-কলমে শেখার বিষয়। তারপর এই যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস। সংক্ষিপ্ত পড়ে সায়েন্সে বাচ্চারা কী শিখবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে ওরা তো অনেক কিছু বুঝবেই না। আর এই পড়াশুনায় ভার্সিটিতেইবা চান্স পাবে কীভাবে?
তার ভাষায়, “সরকারের উচিত হবে ভার্সিটি পর্যায়ে ক্লাস নিয়ে ওদের যেসব জায়গায় গ্যাপ রয়ে গেছে, সেগুলো সমাধান করা।”সংগীত কলেজের শিক্ষার্থী হামিম আজাদের মা নাসিমা বেগমও মনে করেন, পরীক্ষা বিলম্বিত হওয়ায় তার ছেলের ক্ষতি হয়েছে।
“পড়াশুনা ঠিকমতো করছিল। হঠাৎ বন্যার কারণে পরীক্ষা পিছায় গেল, এরপর আর বই নিয়ে বসে না। পড়াশুনা তো চর্চার বিষয়, চর্চা না থাকলে তো হয় না। এভাবে বাচ্চাদের প্রস্তুতি নষ্ট হইছে। আর করোনার কারণে যে ক্ষতি হইছে, সেটা তো বলে বোঝানো যাবে না। ক্লাসে যে পড়াটা হয়, অনলাইনে কী সেটা হয়?”
মিরপুর ১৪ নম্বরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ কেন্দ্রে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, পল্লবী মহিলা কলেজ, ঢাকা মডার্ন কলেজ, সারোজ ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, মিরপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, এস ও এম হারম্যানমেইনার কলেজ, মিরপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজসহ ১৫টি কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছেন।
সেখানেও পরীক্ষার্থী-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তাদের অধিকাংশই এ পরীক্ষার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কিংবা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। মিরপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের পরীক্ষার্থী তানভীর ইসলাম বললেন, “পরীক্ষার আগের কিছুদিন লোডশেডিংয়ের কারণে প্রস্তুতিতে কিছুটা অসুবিধা হয়েছে। তার আগে তো পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়ে আমরা আসলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। অবশেষে পরীক্ষা দিলাম, পরীক্ষা ভালোই হয়েছে।
“তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়েই এখন চিন্তা হচ্ছে। দেড়-দুই মাসের প্রিপারেশনে পুরো সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হবে না।”মিরপুর বাংলা স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী ইরফান আহমেদের বাবা আফসার আহমেদ মনে করেন, বিষয়, নম্বর ও সময় কমিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি।
“এইচএসসি জীবনের অনেক বড় একটা অধ্যায়। এইচএসসি পাস করে শিক্ষার্থীরা যে যার মত উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করে। অথচ এই পরীক্ষা হচ্ছে শর্ট সিলেবাসে। সব বিষয়ে নেওয়া হচ্ছে না। কম নম্বরে নেওয়া হচ্ছে। এটা সরকার বিচক্ষণতার কাজ করেনি।”তার ভাষ্য, “রেজাল্ট ভালো হলেই কী শুধু হবে? এখানে রেজাল্ট ভালো করলেও ওদের পুরো ভবিষ্যতটাই তো পড়ে আছে। ভর্তি পরীক্ষায় গিয়ে এই বাচ্চারা বড় এক ধাক্কা খাবে। যেটা তাদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।”
এসওএস হারম্যানমেইনার কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শেহরীন সুলতানাও সন্তানের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে চিন্তিত। তাই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর আগেই মেয়েকে মেডিকেল ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন।“আমার বাচ্চা রেজাল্ট ভালো করবে এই বিশ্বাস আছে। কিন্তু একটা ভালো মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে বাচ্চারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। এজন্য আগে থেকেই ভর্তি করে রেখেছি কোচিংয়ে। যে একটু ভালো প্রিপারেশন নেবে, সেই এগিয়ে যাবে।”
এদিকে দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যে শঙ্কার কথা জানালেন মিরপুরের সায়েন্স কলেজের সাদমান সাকিব রহানের মা ফয়জুন্নেসা মিতু।কথা প্রসঙ্গে বললেন, “আমাদের এক ভাতিজি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। আমিও ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। বাসায় তো যতটা সম্ভব নিরাপদে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু কেন্দ্র থেকে আক্রান্ত হয় কিনা সেই ভয় পাচ্ছি। আবার পরীক্ষা মধ্যে ডেঙ্গু হলে পরীক্ষাটাই শেষ। এসব নিয়েই চিন্তায় আছি।”