সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ক্ষেতলাল শাখা থেকে ২৮ বছর আগে মৃত্যুবরণকারী শ্রী পরেশ চন্দ্রের নামে দশ হাজার টাকা এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাঠানো হয়। ডাকযোগে পাঠানো ব্যাংকের রেজিস্ট্রিকৃত চিঠিটি মৃত পরেশ চন্দ্রের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র গ্রহণ করেন। চিঠি খুলে তিনি তার বাবার নামে ব্যাংকের দশ হাজার টাকার এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেখতে পান। নোটিশে এক নজর চোখ বুলিয়ে ভেবেছিলেন জীবিত থাকতে হয়তো বাবা ঋণ নিয়েছিলেন। এতদিন পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে। নোটিশের নিচের অংশ গিয়ে তার বাবার ঋণ গ্রহণের তারিখ দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান।
নোটিশে তার বাবার ঋণ গ্রহণের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর। তিনি তখন ছুটে যান সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখায়। ব্যাংকের কর্মকর্তাও তার বাবার ঋণের নথিপত্র ঘেঁটে ঋণ গ্রহণের তারিখ সঠিক থাকার কথা জানান। তখন নরেশ চন্দ্র তার বাবা পরেশ চন্দ্র ২৮ বছর আগে অথাৎ ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন বলে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জানান।
ব্যাংকের কর্মকর্তা তার কথার প্রতিত্তোরে বলেন, আপনার বাবা শ্রী পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবরে ঋণের নথিপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে ঋণ গ্রহণ করেছেন। ঋণের নথিতে আপনার বাবার নাগরিকত্ব সনদ, ছবি-জমির কাগজপত্র স্বাক্ষর সবই আছে।
নরেশ চন্দ্রের কথার সত্যতা যাচাই করতে স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ ও সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখায় গিয়ে দেখা যায়। ব্যাংকে রক্ষিত ৩২৮ নম্বর এমসিডি ঋণের নথিপত্রে পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তিনি ছবি-নাগরিকত্ব সনদ, জমির কাগজ দিয়ে ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর দিয়ে দশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন। ঋণ পরিশোধের পাঠানো নোটিশের সঙ্গে তার মিল রয়েছে।
স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে নরেশের কথার গিয়ে সত্যতা মিলল। আলমপুর ইউনিয়নের ১৯৮৭ সালের ফেরুয়ারি মাসে মৃত্যু রেজিস্টার খোলা হয়। ওই মৃত্যু রেজিস্টারের ৩৮ নম্বর পাতার ৪৩ নম্বর সিরিয়ালে পাঁচুল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বুকের ব্যথার কথা উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, ইউপি চেয়ারম্যান, ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যও জানান, ১৯৯৪ সালের ওই তারিখে পরেশ চন্দ্রের পরলোক গমনের কথা। আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০২১ সালের ৯ মার্চে নরেশ চন্দ্রকে তার বাবার মৃত্যুর সনদ দেয়া হয়েছে। তাতেও তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন উল্লেখ আছে।
পাঁচুইল গ্রামের মৃত পরেশ চন্দ্র দুই ছেলে দুই মেয়ের জনক। বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র, ছোট ছেলে পলাশ চন্দ্র, মেয়ে অতীতা বালা ও গৌরি বালা। মৃত পরেশ চন্দ্রের স্ত্রী মাখন বালা জীবিত রয়েছেন। মৃত পরেশ চন্দের ১২ থেকে ১৪ বিঘা জমি রয়েছে। পরেশ চন্দ্র জীবিত থাকা অবস্থায়ও কোনও ঋণ নেননি বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
নরেশ চন্দ্র বলেন, দশ হাজার টাকা বড় কথা নয়। আমার বাবা মৃত্যুর ১১ বছর পর কিভাবে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ গ্রহণ করলেন তাতে আমরা আশ্চর্য হয়েছি। আমার বাবা মৃত্যুর ১১ বছর পর জীবিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন সেটি সোনালী ব্যাংকে তখন কর্মকর্তারা ছাড়া আর অন্য কেউ দেখেননি। তারা আগে কখনও তার বাবার নামে থাকা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাননি বলে জানিয়েছেন
মৃত্যুর ১১ বছর পর ‘জীবিত হয়ে’ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেন পরেশ চন্দ্র!
মৃত ব্যক্তি জীবিত হয়ে ঋণ গ্রহণ!
মারা গেছেন ১৯৯৪ সালে। মারা যাওয়ার ঠিক ১১ বছর পর তিনি আবার জীবিত হয়েছিলেন। তবে তিনি জীবিত হয়ে নিজের বাড়িতে যাননি আবার পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীরাও কেউ তাকে দেখেননি। তিনি শুধু গিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল শাখায়।ব্যাংকের এ শাখায় ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করে তিনি দশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। শুধু ব্যাংকটির কর্মকর্তারা ছাড়া অন্য কেউ তাকে দেখেননি। ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্টে তা সাক্ষী দিচ্ছে।মৃত্যুর ১১ বছর পর জীবিত হয়ে ব্যাংকে এসে ঋণ নেওয়া ব্যক্তির নাম নাম শ্রী পরেশ চন্দ্র। তার বাবার নাম মৃত কৈলাশ চন্দ্র। তিনি ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের পাঁচুইল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
আলমপুর ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম বলেন, আমার ওয়ার্ডের পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন মারা গেছেন। সেই ব্যক্তি ২০০৫ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে কিভাবে দশ হাজার টাকা নিলেন তা জেনে হতবাক হয়েছি।
সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায় সেই সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল দাবি করে তিনি জানান, পাঁচুইল গ্রামের কার্তিক চন্দ্রের ছেলে শ্রী নরেশ চন্দ্রের নামেও ১৫ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে তার ঋণ গ্রহণের তারিখ ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দেখানো হয়েছে।
নরেশ চন্দ্রের কোনও জমিজমা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, নরেশ চন্দ্র ব্যাংক থেকে কোনও ঋণই নেননি বলে জানিয়েছেন।জানতে চাইলে নরেশ চন্দ্র বলেন, আমার জমিজমা নেই। আমার নামে ১৫ হাজার টাকা ঋণ দেখিয়ে আমাকে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। আমি তো কোনও দিন ব্যাংকে যাইনি। তাহলে ঋণ নিলাম কিভাবে?। ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে ঋণ ডকুমেন্টে তার ছবি-স্বাক্ষর, অনান্য কাগজপত্র দেখা গেছে।
আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম বলেন, পাঁচুইল গ্রামের পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর তারিখ ইউপি কার্যালয়ের মৃত্যু রেজিস্টারে উল্লেখ রয়েছে। ইউপি কার্যালয় থেকে শ্রী পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর ১১ বছর পর কিভাবে ব্যাংক ঋণ পেলেন তা জেনে খুবই আশ্চর্য হয়েছি। ক্ষেতলাল সোনালী ব্যাংকে এক সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। তখন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।
সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র প্রিন্সপাল কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব বলেন, ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্টে দেখা গেছে, উপজেলার পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালে কাগজপত্র ও স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন। ঋণটি পরিশোধ হয়নি। এখন ঋণটি শ্রেণিকৃত হয়েছে। এ কারণে ঋণের আসল টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ করা হয়েছে।শ্রী পরেশ চন্দ্রে তো ১৯৯৪ সালে পরলোক গমন করেছেন তাহলে তিনি কিভাবে ২০০৫ সালে নিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তখন এখানে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলাম না। এ কারণে সেটি আমার জানার কথাও নয়। তবে এক সময় এ শাখায় কৃষি, এমসিডি ও ছাগল ঋণে অনিয়ম হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন।
সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকার কৃষি, এমসিডি ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এরই ৮০ শতাংশ অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে। সেই সময়কার ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর এসব ঋণের দায় বর্তানো হয়েছে। এরমধ্যে কয়েক জন কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। ঋণ অনাদায়ী থাকায় তাদের কারও ১৬ লাখ, ৯ লাখ ও ২৭ লাখসহ বিভিন্ন অংকের টাকা ব্যাংকে কেটে নেয়া হয়েছে।