শুরুতে করোনা মহামারি। তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সবশেষ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে চাল ও ভোজ্য তেলসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম পাগলা ঘোড়ার গতিতে বেড়ে যায়। এতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যআয়ের মানুষ। ব্যয়ের সঙ্গে আয় না বাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করতে জীবনযাত্রার মানে লাগাম টানতে হচ্ছে। ফলে টাকা জমা রাখা তো দূরের কথা ব্যাংকে জমানো অর্থ উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে। অনেকেই এখন সেই জমানো টাকা তুলে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। নতুন সঞ্চয়ের গতিও হ্রাস পেয়েছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবাহ কমছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ ছাড়া জীবনযাত্রার চাহিদা মেটাতে ব্যাংক থেকে সঞ্চয় তুলে নেয়া, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমা ও ডলার সংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে ডলার কেনার কারণে তারল্য ঘাটতি বাড়ছে।
ব্যাংকে হঠাৎ টাকার টান পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকে টাকা রাখা কমছে বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে আমানত বাড়ছে না। সবাই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এদিকে সরকারি হিসাবে দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭.৫৬ শতাংশ, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন বেড়ে গেছে। এতে মানুষের ভোগব্যয় বেড়েছে। খরচের সঙ্গে পেরে না ওঠায় অনেক মানুষ সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে জমানো আমানত ভাঙতে শুরু করেছে। এতে করে টাকা চলে যাচ্ছে ব্যাংকের বাইরে। কেউ আবার মেয়াদপূর্তিতেও পুনর্বিনিয়োগ না করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। অব্যাহতভাবে আমানত কমলে ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি বলে তারা মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সঞ্চয় কমে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। গ্রাহকরা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সঞ্চয় ভাঙলে সেটা আরও খারাপ। ভোক্তাদের ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের মিল নেই। ফলে তারা সঞ্চয় ভাঙছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে এমনটি হয়েছে। এখন দ্রব্যমূল্য কমাতে হবে। তখন ভোক্তার ব্যয় কমবে। সঞ্চয় বাড়তে শুরু করবে। বাজার দরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কয়েক মাস ধরে চাল, ডাল, গম, তেল, ময়দা, লবণসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের পাশাপাশি খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে পোশাক, খাতা-কলম, বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ভাড়া। বিশেষ করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পরপরই জীবনযাত্রার খরচ বাড়তে শুরু করে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, প্রতিটা পণ্যের দাম প্রায় ১০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন তোফায়েল ইসলাম। বলেন, মেয়ের বিয়ে এবং বাড়ির কাজের জন্য ব্যাংকে কয়েক লাখ টাকা জমা ছিল। চিন্তা-ভাবনা ছিল ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মেয়ের বিয়ে ও বাড়ির কাজ শেষ করবেন। কিন্তু চলমান সংকটে সংসার খরচ সামলাতে গিয়ে সেখান থেকে গত কয়েক মাসে লাখ টাকার মতো ভাঙতে হয়েছে। বলেন, আয় না বাড়ায় টাকা যা জমাইছিলাম, গত কয় মাস থেকে খরচ করেছি। তোফায়েলের মতো অনেকেই যে সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। আগের মতো আর টাকা জমাতে পারছেন না।
আরেকটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মী আরশাদুর রহমান বলেন, তাদের বাবা সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। যৌথ পরিবারে তারা তিন ভাই চাকরি করেন। বড় সংসার। গত কয়েক মাস আগেও তাদের আয় আর বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে যেতো। কিন্তু এখন আর চলছে না। বাধ্য হয়ে বাবার ব্যাংকে জমা টাকা থেকে প্রতি মাসে খরচ করতে হচ্ছে।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা তো প্রতিদিনই এগুলো নিয়ে বলছি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনছে না।
পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাধারণত সঞ্চয় করেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। নিত্যপণ্য কেনার খরচ অনেক বেড়েছে। ফলে সংসার চালাতে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিএ) এক জরিপে দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। ঋণ করে খাদ্যের পেছনে ব্যয় করছেন ৩৪ শতাংশ পরিবার। ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবাহ যে কমছে তার প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও দেখা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোতে যেখানে তারল্য প্রবাহ বাড়ার কথা সেখানে গত এক বছরে তা কমেছে। গত বছরের জুনে ব্যাংকিং খাতে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে তারল্য কমছে ৯ হাজার কোটি টাকা। মোট তারল্যের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা হিসাবে রাখা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য হিসাবে ব্যাংকে পড়ে রয়েছে। এক বছর আগে এই অতিরিক্ত তারল্য ছিল আড়াই লাখ কোটি টাকা। এক বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য কমেছে।
গত অর্থবছরে ব্যাংক খাতে যোগ হওয়া নিট আমানতের পরিমাণ (নতুন জমা আমানত আর তুলে নেয়া আমানতের হিসাব সমন্বয়ের পর এক বছরে পাওয়া আমানতের পরিমাণ) আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ কমে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ২০ হাজার ২৯৫ কোটি টাকার নিট আমানত যোগ হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে যোগ হয়েছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকার আমানত। এই হিসাবে গত অর্থবছর ব্যাংক খাতে যোগ হওয়া আমানত ২৯.১৪ শতাংশ কমেছে। অথচ আগের অর্থবছরে মহামারির মধ্যেই নতুন আমানতে ৪৫.৯৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
গত বছরের জুন শেষে দেশে ব্যাংক খাতে মোট সঞ্চিত আমানত ছিল ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। এক বছরের মাথায় এ বছরের জুন শেষে তা বেড়ে ১৪ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা হয়। কিন্তু জুলাই মাসে তা কমে ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এক মাসে ব্যাংকে আমানত হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ কমেছে ৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। বিষয়টি অর্থনীতির জন্য ‘ভালো লক্ষণ’ নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আমানত এভাবে কমতে থাকলে ব্যাংক খাতের তারল্যে চাপে পড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও প্রণোদনা প্যাকেজের তৃতীয় ধাপের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সচল হতে পারবেন। আশা করা যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে আমানত প্রবৃদ্ধি ফের আগের জায়গায় ফিরে যাবে। ফলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।