সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং অর্ধেকে নেমে আসবে এমনটাই ঘোষণা দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। চলতি মাসের মাঝামাঝি লোডশেডিং কিছুটা কমেও এসেছিল। তবে হঠাৎ করেই গত এক সপ্তাহে তা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি। দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং দেয়া হবে বলে ঘোষণা থাকলেও রাজধানীতেই এলাকাভেদে চার থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর বাইরে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। গ্রামাঞ্চলে দিনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। এর মূল কারণ, গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল সংকট। একদিকে পেট্রোবাংলার বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, অপরদিকে আমদানি বিল ঠিকমতো পরিশোধ না করায় ফার্নেস অয়েলের আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিক। এর প্রভাবে ছয় দিনের ব্যবধানে পিক আওয়ারে সাবস্টেশন পর্যায়ে লোডশেডিং বেড়ে ১০ গুণ হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, গেল সপ্তাহের মধ্যে গত ২৩ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) পিক আওয়ারে (রাত ৯টায়) সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে লোডশেডিং হয় মাত্র ১৪৩ মেগাওয়াট। ওই সময় সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ২৯ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয় ১২ হাজার ৮৮৬ মেগাওয়াট। ওইদিন রাত ৯টায় দেশের ৯টি জোনের মধ্যে সাতটিতেই সাবস্টেশন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং হয়নি। বাকি দুটির মধ্যে ময়মনসিংহ জোনে ১৩৩ মেগাওয়াট ও কুমিল্লা জোনে ১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
পরের দিন ২৪ সেপ্টেম্বর (শনিবার) পিক আওয়ারে সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে লোডশেডিং বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৩ মেগাওয়াট। ওই সময় সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয় ১২ হাজার ৪৪৬ মেগাওয়াট। ওইদিন রাত ৯টায় দেশের ৯টি জোনের মধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও বরিশাল জোনে সাবস্টেশন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং হয়নি। বাকি পাঁচটিতে লোডশেডিং হয়। এর মধ্যে ঢাকা জোনে ১৪২ মেগাওয়াট, খুলনায় ১৭৭, রাজশাহীতে ১৩৪, ময়মনসিংহে ১৪২ ও রংপুর জোনে ১০৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
২৫ সেপ্টেম্বর (রোববার) রাত ৯টায় সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে লোডশেডিং কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৮০ মেগাওয়াট। ওই সময় সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ১৪৮ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয় ১২ হাজার ৪৬৮ মেগাওয়াট। ওইদিন রাত ৯টায় দেশের ৯টি জোনের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল জোনে সাবস্টেশন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং হয়নি। বাকি ছয়টিতে লোডশেডিং হয়। এর মধ্যে ঢাকা জোনে ১০৮ মেগাওয়াট, খুলনায় ১৬৮, রাজশাহীতে ৯২, কুমিল্লায় ১১৫, ময়মনসিংহে ১১৯, ও রংপুর জোনে ৭৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
২৬ সেপ্টেম্বর (সোমবার) পিক আওয়ারে সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে লোডশেডিং অনেকটা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ১৭১ মেগাওয়াট। ওই সময় সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৫৬৮ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয় ১২ হাজার ৩৯৭ মেগাওয়াট। ওইদিন পিক আওয়ারে দেশের ৯টি জোনের মধ্যে শুধু বরিশালে সাবস্টেশন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং হয়নি। বাকি আটটিতেই লোডশেডিং হয়। এর মধ্যে ঢাকা জোনে ৩৬০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামে ৩৪, খুলনায় ১৭৪, রাজশাহীতে ১৩০, কুমিল্লায় ১৭০, ময়মনসিংহে ৯৩, সিলেটে ১০০ ও রংপুর জোনে ১১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
২৭ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) পিক আওয়ারে সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে লোডশেডিং আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২৪৭ মেগাওয়াট। ওই সময় সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৬৩৫ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয় ১২ হাজার ৩৮৮ মেগাওয়াট। ওইদিন পিক আওয়ারে দেশের ৯টি জোনের মধ্যে চট্টগ্রাম ও বরিশালে সাবস্টেশন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং হয়নি। বাকি সাতটিতে লোডশেডিং হয়। এর মধ্যে ঢাকা জোনে ২০৯ মেগাওয়াট, খুলনায় ২৪৭, রাজশাহীতে ১৫৮, কুমিল্লায় ১৭০, ময়মনসিংহে ২০৮, সিলেটে ১০৭ ও রংপুর জোনে ১৪৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
এদিকে ২৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) পিক আওয়ারে সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে লোডশেডিং আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৭১ মেগাওয়াট। ওই সময় সারাদেশে সাবস্টেশন পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৭১৩ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয় ১২ হাজার ২৪২ মেগাওয়াট। ওইদিন পিক আওয়ারে দেশের ৯টি জোনের মধ্যে শুধু বরিশালে সাবস্টেশন পর্যায়ে কোনো লোডশেডিং হয়নি। বাকি আটটিতে লোডশেডিং হয়। এর মধ্যে ঢাকা জোনে ৩৪৫ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামে ১৯০, খুলনায় ২৩০, রাজশাহীতে ১৪৪, কুমিল্লায় ৯৮, ময়মনসিংহে ১৭৭, সিলেটে ১১৮ ও রংপুর জোনে ১৬৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
এ প্রসঙ্গে পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক গ্যাস দরকার দুই হাজার ২৫২ এমএমসিএফ। তবে পেট্রোবাংলা থেকে গত সপ্তাহে সরবরাহ করেছে দৈনিক এক হাজার এমএমসিএফের চেয়ে কম। তাই গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বড় অংশ বন্ধ ছিল। আর ফার্নেস অয়েলচালিত বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর নিজেরাই তেল আমদানি করে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় গত মার্চ থেকে নিয়মিত ভর্তুকির অর্থ ছাড় করছে না। ফলে তেল আমদানির বিলও কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি ক্যাপাসিটি চার্জও বকেয়া পড়েছে। এতে কয়েকটি কোম্পানি তেল আমদানি বন্ধ রেখেছে। ফলে ফার্নেস অয়েলচালিত কয়েকটি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে।
পিডিবির তথ্যমতে, গ্যাস-তেল সংকটে গতকাল তিন হাজার ৪৬৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল। এর মধ্যে ১২টি গ্যাসচালিত কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ ছিল ও ১২টি কেন্দ্র আংশিক বন্ধ ছিল। আর একটি কেন্দ্রে গ্যাসের পরিবর্তে ডিজেলে উৎপাদন করা হয়েছে। এছাড়া আটটি ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ ছিল। তবে বেসরকারি খাতের ডিজেলচালিত ছয়টি কেন্দ্রে চালু ছিল।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাঝে আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে বিদ্যুৎ খাতে বাড়ানো হয়েছিল। তবে আবার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত সপ্তাহে আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতে কমাতে হয়েছে। মূলত এ কারণে বিদ্যুৎ খাতে সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানি লোডশেডিংয়ের হিসাবে গোঁজামিল দিয়ে যাচ্ছে। গত সোমবার ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) জানায়, মঙ্গলবার কোম্পানিটির বিদ্যুৎ বিতরণকৃত এলাকায় কোনো লোডশেডিং হবে না। অথচ ওইদিন এক ঘণ্টার পরিবর্তে এলাকাভেদে দুই থেকে তিন ঘণ্টা করে লোডশেডিং হয়। মঙ্গল ও বুধবার লোডশেডিং পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। দিনের পাশাপাশি রাতে এমনকি গভীর রাতেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং চলে।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, পিডিবিকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে না। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোয় লোডশেডিং প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। অনেক এলাকাতেই সে সময় লোডশেডিং করতে হয়নি। তবে গত কয়েকদিনে পিডিবি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
একই ধরনের বক্তব্য জানান ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমির আলী। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি লোডশেডিং অনেক কমে গিয়েছিল। বিভিন্ন এলাকায় আধা ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়া হয়েছে। কোনো কোনোদিন লোডশেডিং করাও লাগেনি। তবে গেল সপ্তাহে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস দৈনিক এক হাজার এমএমসিএফের বেশি সরবরাহ করা হতো। গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছিল। তবে হঠাৎ করে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে গেছে। এতে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং বাড়াতে হয়েছে। তবে আগামী মাসে তাপমাত্রা কমে আসবে। তখন লোডশেডিং শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যাবে।