সারা বিশ্বে চলমান অর্থনৈতিক ধাক্কা আঘাত করেছে দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ধারায়। সদ্য বিদায়ি সেপ্টেম্বর মাসে একই সঙ্গে রফতানি ও রেমিট্যান্স আয়ের ধারা নিম্নমুখী। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। গত মাসে এ খাতের আয় কমেছে একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে প্রায় ১৫৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এর আগের বছর এসেছিল ১৭২ কোটি ডলার।
করোনা মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্স প্রবাহে যেভাবে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছিল, এখন ঠিক তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বর শেষে ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এই অঙ্ক গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এ ছাড়া বিদায়ি আগস্ট মাসের তুলনায় প্রায় ৫০ কোটি ডলার কম এসেছে রেমিট্যান্স। প্রবাসী আয়ের এ ধারায় শঙ্কিত অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে রফতানি আয় ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশে চলমান ডলারের সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। এ ধারা সামনের মাসগুলোতে অব্যাহত থাকলে দৃশ্যমান সঙ্কট অর্থনীতিতে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ১৪৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। তবে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত রেমিট্যান্স বেড়েছে। অর্থাৎ গত সাত মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বরেই সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে টানা দুই মাস দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স বৈধ পথে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগস্ট মাসে ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। তার আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। জুলাই মাসে পবিত্র ঈদুল আজহার কারণে বেশি পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল। তবে আগস্টে বড় উৎসব ছিল না, তারপরও প্রবাসী আয় ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বিদায়ি সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১২৬ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৬১ লাখ মার্কিন ডলার। আর বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে দুই কোটি ৪১ মার্কিন ডলার। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আহরণ করেছে অগ্রণী ব্যাংক। এ ব্যাংকটি আলোচিত সময়ে ৯ কোটি ৫৫ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছে। এরপরই আছে বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী। এ ব্যাংকটি সাত কোটি ৭১ লাখ ডলার আহরণ করতে সমর্থ হয়েছে।
আলোচিত সময়ে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বরাবরের মতো বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রবাসীরা ৩৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। এরপর সিটি ব্যাংকে এসেছে ১১ কোটি ২৮ লাখ ডলার, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ১০ কোটি ৭২ লাখ ডলার। এ ছাড়া ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে সাত কোটি ৯২ লাখ ডলার প্রবাসী আয়।
সম্প্রতি রেমিট্যান্স পাঠাতে ও আহরণে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে যেকোনো পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাতে কোনো ধরনের কাগজপত্র লাগছে না। প্রবাসী আয়ের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোও সেপ্টেম্বর মাসের আগে নিজেরাও বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করত। কিন্তু ডলারের একদর বেঁধে দেওয়ায় এ অতিরিক্ত দেওয়ার সুযোগ নেই বলে প্রবাসী আয় কমেছে দাবি করেন এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘রফতানি বাণিজ্য আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে বেশি সংঘটিত হয় না। আবার এলসি ওপেন করতে হয় ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু আমাদের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে না। তাই আমাদের বড় ভরসা প্রবাসী আয়। কিন্তু ডলারের একদর বেঁধে দেওয়ার পর রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। আমরা সামান্য কিছু বেশি দিয়ে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করতাম। কিন্তু সে পথও এখন বন্ধ। বড় ব্যাংকগুলোর তো কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা যা হওয়ার সব আমাদের।’ গত মাসে বাফেদা ও এবিবি সম্মিলিতভাবে দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য ডলারের একক দর নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারণ করা দরের চেয়ে হুন্ডিতে আরও অনেক বেশি পাওয়া যায় ডলারের রেট। এ কারণে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে হুন্ডিতে ঝুঁকছেন বলে দাবি করেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি।
বাফেদার ঘোষিত দাম অনুযায়ী, এখন দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা ৫০ পয়সায় কিনতে পারবে ব্যাংকগুলো। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৮ টাকা।