করোনার অচলাবস্থা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠেছে দেশের অর্থনৈতিক খাত। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও বেড়েছে। ডলার সঙ্কট কাটাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব পদক্ষেপে এ খাতের ঋণ গ্রহণ কমেনি। চলতি বছরের আগস্ট মাস শেষে এ খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। জুলাই মাসের তুলনায় এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৫ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক হালনাগাদকৃত তথ্যে এ চিত্র দেখা যায়।
সূত্র মতে, চলতি বছরের জুলাই শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ ছাড়া গত বছর ২০২১ সালে এই খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। সম্প্রতি প্রায় সব রকমের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ঋণ চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া নতুন করে কিছু বিনিয়োগসহ নানা কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানা গেছে। অবশ্য গত জুলাইতে বেশ কিছু পণ্য আমদানি ঋণ নিষিদ্ধ করা হয়। ডলার সঙ্কট কাটাতে কম প্রয়োজনীয় এবং বিলাসপণ্য আমদানিতে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।
এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে যা ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল। মূলত সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্লেষণ করে মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন কিছুটা কমানো হয়। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রাক্কলনের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়েছে। যে কারণে এখন সব পর্যায়ে খরচ বেড়েছে। এ সময় নতুন করে অনেকে বিনিয়োগও করছেন। এসব কারণে গত এপ্রিলে এক নির্দেশনার মাধ্যমে চলতি মূলধন খাতে বিদ্যমান ঋণসীমা বাড়ানোর সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য এ নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমাতে গত জুলাইতে কিছু পণ্য আমদানিতে ৭৫ থেকে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ এবং এসব পণ্যে ঋণ দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এরপরও ঋণ বেড়ে আগস্টে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। জুলাইতে যা ছিল ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ‘সাম্প্রতিক কয়েক বছর বিনিয়োগ চাহিদা কম রয়েছে। সাধারণভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে থাকলেও ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো তা নেমে আসে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর ব্যাপক হারে কমে ২০২০ সালের মে শেষে প্রবৃদ্ধি নামে সাত দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে পরের মাস জুন থেকে একটু করে বাড়তে থাকে এ খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি।’
বিগত বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ হয়। আগস্টে তা আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশে এবং সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে।
তবে ২০২০ সালের অক্টোবরে এই প্রবৃদ্ধি কমে আট দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। নভেম্বরে তা আরও কমে আট দশমিক ২১ শতাংশ হয়। ডিসেম্বরে সামান্য বেড়ে আট দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়।
২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল আট দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে আট দশমিক ৫১ ও আট দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে নেমে আসে আট দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় সাত দশমিক ৫৫ শতাংশে।
তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে আট দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। তারপর থেকে ঋণপ্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
গত বছরও করোনার আঁচ লেগেছিল শিল্প খাতে, ফলে বিনিয়োগে দেখা দেয় ধীরগতি। তবে করোনার পর সবকিছু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফেরায় দেশের অর্থনীতিতেও গতি আসে। বর্তমানে দেশে ফের পুরোদমে শুরু হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
এদিকে করোনার অভিঘাত কাটিয়ে শিল্প-কলকারখানার চাকাও ঘুরছে আগের মতো। এতে দেশের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দেশের প্রধান রফতানি আয়ের ৮৪ ভাগ নেতৃত্ব দেওয়া তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আদেশ আবারও আগের অবস্থানে ফিরেছে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে শিল্প খাতে প্রান্তিক ঋণের প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে।