সুদানের যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সৌদি এবং মার্কিন কূটনীতিকদের কথা বলতে হচ্ছে বিবদমান দুই নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে আসা জেনারেলদের সঙ্গে। দুই পক্ষই তিনজনের একেকটি প্রতিনিধিদল জেদ্দায় পাঠিয়েছে। খবর বিবিসি।বৈঠকের মূল এজেন্ডা হলো মানবিক সংকট নিরসনে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি যেখানে যুদ্ধবিরতি কাজ করছে কিনা তার নজরদারির ব্যবস্থা থাকবে এবং ত্রাণ-সাহায্যের নিরাপদ করিডোরের নিশ্চয়তা থাকবে।
কোনো পক্ষই এখন সংকটের রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে মীমাংসায় বসতে প্রস্তুত নয়।যেসব নাগরিক সংগঠন এবং গোষ্ঠীর আন্দোলনে চার বছর আগে ওমর আল-বশিরের দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের পতন হয়েছিল, তারা এখন শুধুই নীরব দর্শক।কিন্তু সুদানের দুই জেনারেলকে এখন এমনকি একটি সোজাসাপ্টা যুদ্ধবিরতিতে রাজি রানোটাও সহজ হবেনা।
সেনাপ্রধান জে. আব্দেল ফাতাহ আল বুরহান দাবি করবেন তিনিই দেশের বৈধ প্রতিনিধি, আর তার প্রতিপক্ষ জে. মোহামেদ হামদান দাগালো, যিনি হেমেটি নামে বেশি পরিচিত, একজন বিদ্রোহী।কিন্তু হেমেটি, যিনি কার্যত জে. বুরহানের ডেপুটি ছিলেন, সমান মর্যাদা দাবি করবেন। তিনি চাইবেন একটি স্থিতাবস্থা, যাতে তার আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) রাজধানী খার্তুমের সিংহভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।
ফলে, এই দুই জেনারেলেকে একটি আপোষে রাজি করানো খুবই কঠিন একটি কাজ হতে পারে। মধ্যস্থতাকারীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে দুই পক্ষের আস্থা অর্জন, তাদের ভরসা দেওয়া যে আপোষ করলে তাদের কেউই বিপদগ্রস্ত বা দুর্বল হয়ে পড়বেনা।কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা যেটা হতে পারে তা হলো দুই পক্ষই দাবি করবে ভবিষ্যতে সুদানের রাজনৈতিক মীমাংসায় যেনো তারাই প্রাধান্য পায় এবং সেই মীমাংসা আলোচনার এজেন্ডা যেন তাদের সুবিধা মতো হয়।
বুরহান বা হেমেটি এবং সুদানের আরব প্রতিবেশীরা একটি বিষয়ে একমত যে তাদের কেউই এখন সুদানে গণতান্ত্রিক কোনো সরকার চায়না, যে সম্ভাবনা নিয়ে লড়াইয়ের আগে কথা হচ্ছিল।২০১৯ সালে বশিরের পতনের পর থেকে এই দুই জেনারেলই সুদানের ক্ষমতায় এবং এই ক্ষমতা ছাড়তে তারা নারাজ। ফলে, বেসামরিক যে জনগণ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য ২০১৯ সালে বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল, তারা কিছুই পাইনি। দুই জেনারেলের মধ্যে আরেকটি বিষয়ে ঐক্যমত্য রয়েছে, যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গটি যেন চিরতরে মুছে ফেলা হয়।
সুতরাং, জেনারেলদের নিয়ে এই বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে একটি শান্তি চুক্তি হয়তো হবে কিন্তু তার ফলে সুদানের গণতান্ত্রিক একটি সরকার প্রতিষ্টার সম্ভাবনা কয়েক বছর পিছিয়ে যাবে। আর যদি যুদ্ধবিরতির কোনো চুক্তি করা না যায়, তাহলে রাষ্ট্র হিসাবে সুদান ভেঙে পড়বে।আবদাল্লাহ হামদক, ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের আগে যিনি সুদানের অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষমতা ভাগাভাগির সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বলেছেন তার দেশের নতুন এই যুদ্ধ সিরিয়া বা ইয়েমেনের চেয়েও মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
সুদানের এই যুদ্ধ কীভাবে গৃহযুদ্ধে পরিণত হতে পারে তা নিয়ে অনেকেই ভয়ংকর সব সম্ভাবনার কথা বলতে শুরু করেছেন। লড়াইয়ের শুরুর দিকে ক্রুদ্ধ সামরিক কম্যান্ডাররা, সেনাবাহিনীর জেনারেলরা এবং বিদ্রোহীরা, একপক্ষ অন্যপক্ষকে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করতে চেয়েছে।আরএসএফের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে দারফুরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাদের অনেক যোদ্ধার বিরুদ্ধে এমন সব নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে যেগুলোকে আন্তর্জাতিক আদালত বা আইসিসি গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে।তেমন নৃশংসতা আমরা সুদানে আগেও দেখেছি যখন ১৯৮৩ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় বা তারও ২০ বছর আগে দারফুরে বা ২০১১ সালে যখন দক্ষিণ সুদান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দক্ষিণ সুদানে ২০১৩ সালের গৃহযুদ্ধে এমনটা দেখা গেছে।
গত ১৫ই এপ্রিল যখন সেনাবাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে লড়াই বাঁধে, একপক্ষ আরেক পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে।রাজধানীতে একপক্ষ অন্যের কৌশলগত অবস্থানে নির্বিচারে গোলাবর্ষণ শুরু করে। শহর এবং শহরের বাসিন্দাদের ওপর তার পরিণতি নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র ভাবেনি।
আগেও সুদানের যুদ্ধগুলোতে দেখা গেছে দ্রুত না থামতে পারলে তা বিস্তৃত হয়। দুপক্ষ তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তি বাড়াতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে। স্থানীয় সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। বিদেশীদের কাছ থেকে সাহায্য-সমর্থনের চেষ্টা শুরু করে।সুদানে এখন তেমন একটি পরিস্থিতি চোখে পড়ছে।যে কোনও লড়াইতেও দুই পক্ষই দীর্ঘ সময়ের জন্য সমানভাবে শক্তি ধরে রাখতে পারেনা। তাদের অস্ত্র-সরঞ্জাম, টাকা-পয়সায় টান পড়ে। পুষিয়ে নিতে তারা তখন অন্যের সঙ্গে বোঝাপড়া করে।সুদানেও এখন দেখা যাবে বাইরের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী একেকটি পক্ষ নিয়ে লড়াইতে সামিল হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আত্মরক্ষায় অস্ত্র তুলে নেবে। বিদেশী বিভিন্ন শক্তি এই সংঘর্ষে জড়িত হবে।
এখনই সেসব লক্ষণ চোখে পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে হেমেটির জন্মস্থান দারফুরে পরিস্থিতি আবারো অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র জাতিগোষ্ঠীর বিবেচনায় বেসামরিক লোকজনকে হামলার টার্গেট করা হচ্ছে। এ ধরণের নৃশংসতা খুবই বিপজ্জনক কারণ এতে দ্রুত প্রতিহিংসা ছড়িয়ে পড়ে।পরবর্তী পর্যায়ে যা দেখা যেতে পারে তা হলো সংঘাত পুরো সুদানে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তার ফলে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন বিরোধ জন্ম নিচ্ছে। আরও দেখা যাবে অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত বিভিন্ন স্থাপনা যেমন সড়ক, বিমানবন্দর, সোনার খনি এবং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র দখলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠেছে।
দারফুরে ২০০৩-২০০৪ সালে এমন নৃশংস লড়াই এবং গণহত্যা হয়েছে। পুরো অঞ্চলে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়েছিল তখন। সেসময় আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের যৌথ এক মিশনের প্রধান মন্তব্য করেছিলেন ‘সবাই সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।’ এই ধরনের অরাজক রাজনৈতিক আবহ হেমেটির খুবই পছন্দ। টাকা-পয়সা এবং সহিংসতা ছড়িয়ে শক্ত ভিত্তি তৈরিতে সে পারঙ্গম। একসময়কার দারফুরের মত পুরো সুদানের জন্য এখন এমনই এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যপট তৈরির আশংকা তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি মধ্যস্থতাকারীরা বেশ উঁচু পর্যায়ের এবং তারা কোনো একটি পক্ষকে বিশেষভাবে সমর্থন করছেন না, যেমনটা করছে বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ আরব দেশ। মিশর সমর্থন করছে জে বুরহানকে, অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে হেমেটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছে। তাতে দুই জেনারেল যে দমবে সে সম্ভাবনা কম। ১৯৮৯ থেকে দীর্ঘদিন ধরে সুদানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেদেশে সেনাবাহিনীর ব্যবসা বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
দুই জেনারেলকে কাবু করতে এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ঐকমত্য। চীন এবং রাশিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ সব দেশকে এই যুদ্ধের বিপক্ষে ভূমিকা নিতে হবে। জাতিসংঘের আফ্রিকান সদস্যদের এখতিয়ার রয়েছে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
লড়াই শুরুর পরদিনই আফ্রিকান ইউনিয়ন জোট তাদের নিরাপত্তা কমিটির একটি বৈঠক ডেকেছিল, কিন্তু সৌদি-মার্কিন উদ্যোগের সঙ্গে তারা নেই। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে এই সংঘাত আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। পুরোপুরি অস্ত্র-বিরতি এখন খুবই কঠিন। বিভিন্ন আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠী যদি তৎপর হয়ে ওঠে তাহলে সেকাজ আরও জটিল হয়ে পড়বে।
সুদানে এবার যেটা নজিরবিহীন তা হলো লড়াইয়ের মূল মঞ্চ খার্তুম। এর আগে বিভিন্ন সংঘাতে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে প্রধানত রাজধানীর বাইরে, বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায়। নগরের মানুষদের কাছে বিভিন্ন সেবা অপরিহার্য বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন। ফলে, টাকা-পয়সার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শাখা বন্ধ। ফলে লেনদেনের জন্য অনেক মানুষের এখন একমাত্র ভরসা মোবাইল ব্যাংকিং। বহু মানুষ কপর্দকহীন হয়ে পড়েছে।জাতিসংঘ এবং বিদেশী ত্রাণ কর্মীরা পালিয়ে যাওয়ায় শূন্যস্থান পূরণে বাসিন্দারা স্থানীয়ভাবে কমিটি তৈরি করে জরুরী ত্রাণ বা শহর থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করছে। অনেক সুদানি মনে করছে প্রয়োজনের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের ত্যাগ করেছে। তাদের ভরসা এখন স্থানীয় এসব নাগরিক কমিটি।
ফলে, আশংকা দেখা দিয়েছে যুদ্ধবাজ গোষ্ঠী নেতারা খাবার এবং ত্রাণ কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুঠতে পারে। সুদানের এই লড়াইয়ের সহজ কোনো সমাধান নেই। বরঞ্চ পরিস্থিতি ভালো হওয়ার চেয়ে আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।ফলে সৌদি আরবে এই যুদ্ধবিরতির মীমাংসা বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়, কারা এই মীমাংসা বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করছে, কোন শর্তে করছে, তাদের এজেন্ডা কী – তার ওপরে নির্ভর করছে আগামী বছরগুলোতে সুদানের পরিণতি কী দাঁড়াবে।