ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন দিকে মোড় নেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এই মোড় ঘোরানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখবে ট্যাংক। যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি তাদের কাছে থাকা সবচেয়ে অত্যাধুনিক ট্যাংক ইউক্রেনকে দিতে রাজি হয়েছে। এর মাধ্যমে রাশিয়ার দখল করা এলাকা প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বাহিনী পুনরুদ্ধার করতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যদিও ইউক্রেন সরকার তার চাহিদামতো সব ট্যাংক পাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিসহ ইউরোপের নেতারা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। রাশিয়া সতর্ক করেছে, অন্য সবকিছুর মতো এসব ট্যাংকও পুড়ে যাবে। আর এতে বরং ইউক্রেনের দুর্ভোগ বাড়বে।
ট্যাংকে ঘুরবে যুদ্ধের মোড়!
কয়েক মাস যাবত অনিচ্ছার পরে আমেরিকা এবং জার্মানি ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ট্যাংক ইউক্রেনের হাতে এলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে বলে তারা আশা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন অন্তত ৩০টি এম ওয়ান আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শোলত্জ অন্তত ১৪টি লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। আমেরিকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এসব খবরকে সরাসরি উসকানি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার কাছে হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করবে। ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠনোর জন্য আমেরিকা এবং জার্মানি এতদিন ধরে দেশের ভেতরে এবং বাইরে নানা চাপ উপেক্ষা করেছে। ওয়াশিংটন বলছে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আব্রামস ট্যাংক পরিচালনার জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। অন্যদিকে বার্লিন আশঙ্কা করছে, ট্যাংক সরবরাহের মাধ্যমে ন্যাটো রাশিয়ার বিপক্ষে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম বলছে, জার্মানির পক্ষ থেকে আমেরিকাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছিল যে, আমেরিকা যদি এম ওয়ান আব্রামস ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠায় তাহলে জার্মানিও লেপার্ড-২ ট্যাংক পাঠাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ৩০টি ট্যাংক পাঠানো হতে পারে। ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর এবং বাইডেনের সহযোগী ক্রিস কুনস সংবাদ মাধ্যম পলিটিকোকে বলেন, ‘যদি জার্মানরা বলে যে, আমেরিকানরা আব্রামস পাঠালে তারা লেপার্ড পাঠাবে তাহলে আমাদের আব্রামস পাঠানো দরকার।’ ব্রিটেন এরই মধ্যে বলেছে যে, তারা ইউক্রেনে চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক পাঠাবে।
পোল্যান্ড চলতি সপ্তাহে বলেছে যে, তারা লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠাতে চায়। এসব ট্যাংক যেহেতু জার্মানিতে তৈরি, তাই বার্লিনকে তাদের রপ্তানির অনুমোদন দিতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্য অনুসারে, অন্তত ১৬টি ইউরোপীয় ও ন্যাটোভুক্ত দেশের কাছে লেপার্ড-২ ট্যাংক রয়েছে। এদের সবাই ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠাবে না। কিন্তু শোলেজর আপাতত সিদ্ধান্তের অর্থ হলো তারা চাইলেই পাঠাতে পারে। বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক করেসপনডেন্ট জনাথন বিয়েল বলেন, ইউক্রেন মনে করে, ৩০০ আধুনিক ট্যাংক পেলে তারা যুদ্ধে জিততে পারবে। কিন্তু তাদের প্রয়োজন মতো ট্যাংক পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে উল্লেখ করেন বিয়েল। কিন্তু যদি আধা ডজন পশ্চিমা দেশের প্রত্যেকে ১৪টি করে ট্যাংক সরবরাহ করে, তাহলে এটি ট্যাংকের সংখ্যা প্রায় ১০০’র কাছাকাছি নিয়ে যাবে, যা যুদ্ধে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস এর আগে বলেছিলেন, বার্লিন অন্যান্য দেশগুলোকে ইউক্রেনীয়দের লেপার্ড-২ ট্যাংক ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছে কিন্তু তাদের নিজস্ব ট্যাংক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
কতটা শক্তিশালী এই ট্যাংক
জনাথন বিয়েল বলেন, যুক্তরাজ্যের চ্যালেঞ্জার-২, জার্মানির লেপার্ড-২ এবং মার্কিন তৈরি আব্রামসসহ পশ্চিমা ট্যাংকগুলো সোভিয়েত যুগের একই ধরনের ট্যাংক যেমন টি-৭২ এর চেয়ে উচ্চমানের। এই ট্যাংকগুলো ইউক্রেনীয় বাহিনীর সদস্যদের আরো বেশি সুরক্ষা, গতি এবং নির্ভুলতা দেবে। কিন্তু পশ্চিমা আধুনিক প্রধান যুদ্ধ ট্যাংকগুলো নিজেরাই কোনো বিস্ময়কর অস্ত্র বা গেম-চেঞ্জার নয়। বরং সেগুলোর সঙ্গে অন্য কী ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিয়েল। জার্মানির তৈরি লেপার্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আব্রামস। দুটো ট্যাংকের মধ্যে মূলত ইঞ্জিনই বড় পার্থক্য তৈরি করেছে। লেপার্ড-২ ট্যাংকের ইঞ্জিন এমটিইউ এমবি৮৭৩ ডিজেল ইঞ্জিন। এতে দুইজন ক্রু। এর সর্বোচ্চ পাল্লা ৫০০ কিলোমিটার। ঘণ্টায় গতি ৭২ কিলোমিটার। এর অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে রাইনমেটাল ১২০ এমএম এল৫৫ স্মুথবোর বন্দুক, কোয়াক্সিয়াল ৭.৬২এমএম মেশিনগান এবং ৭.৬২এমএম অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট মেশিনগান। আব্রামসের ১৫০০ এইচপি গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন। এর ক্রু আছে চার জন। সর্বোচ্চ পাল্লা ১ হাজার ৫ কিলোমিটার ও সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার। অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এম২৫৬১২০এমএম স্মুথবোর ক্যানন, ১২.৭এমএম মেশিনগান এবং ৭.৬২এমএম এমএম২৪০ মেশিনগান।
শেষ পর্যন্ত রাজি হলো জার্মানি
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছে আধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহের দাবি জানিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই সরবরাহ করা হয়নি। জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। গতকাল বুধবার সকালে জার্মান পার্লামেন্টে ভাষণ দেন চ্যান্সেলর ওলাফ শোলত্জ। পার্লামেন্টে ইউক্রেনকে ট্যাংক দেওয়ার কথা জানানোর আগে তিনি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন। উদারপন্থি এফডিপি পার্টির মারি-অ্যাগনেস স্ট্র্যাক-সিমারম্যান (জার্মান পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান) বলেন, তিনি এ ধরনের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছেন।
অনুমোদন শীর্ষ মার্কিন আইনপ্রণেতাদের
যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েক জন শীর্ষ আইনপ্রণেতা মঙ্গলবার ইউক্রেনে আমেরিকান সহায়তার পরবর্তী বড় পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। রাশিয়ার আগ্রাসনের মোকাবিলায় এম-ওয়ান আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে, তারা হোয়াইট হাউজকে উত্সাহিত করেছেন। রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম মঙ্গলবার কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্বমূলক এক সফর শেষে ইউক্রেন থেকে ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে খুব কম দেশই ট্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে।